বুধবার, মার্চ ২৫, ২০০৯

স্মৃতির সাথে ছাড়াছাড়ি


দেখতে দেখতে সাত বছর চলে গেলো। অথবা অনেক লম্বা সময় পাড়ি দেবার পর মনে হলো, সাত বছর পেরিয়েছে। ঘর ছাড়ার, বাড়ি ছাড়ার। মানে, জীবনকে পেছনে ফেলে আসার। এখনকার দাড়িয়ে থাকা বিন্দু থেকে দেখলে সাত বছর আগের সময়গুলোকে স্পষ্ট মনে পড়ে না। ভালোমতোন মনে করার চেষ্টা করে দেখলেও নয়। অনেক কাল আগে পড়ে বইয়ের তাকে রেখে দেয়া কোন সাদামাটা বইয়ের বিস্মৃতপ্রায় পাতায় লেখা ছাপার হরফের মতো মনে হয়। অক্ষরগুলো সামনে দিয়ে চলে যায়, কিন্তু স্পষ্ট মনে করতে পারি না কোন শব্দ বা কোন বাক্য। চরিত্রগুলো আবছা উঁকি দিয়ে যায় কেবল। তবু হাতড়ে দেখি, খুঁজতে থাকি সেইসব হারিয়ে যাওয়া পৃষ্ঠা।

আরেকবার বাসা বদলেছি, বছর চারেক পর। বাসার সাইজ পাল্টায় নি অবশ্য। একটা পাখির বাসা থেকে আরেকটা পাখির বাসা। সেই নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম কিছুটা সময়। ক্লান্তও বটে। বেশ ঝক্কির বিষয়। প্যাকেট বাঁধতে হয়, ময়লা ফেলতে হয়, নিজেও কিছুটা সাহায্য করতে হয় রিলোকেশন সার্ভিস এর লোকদের। এই কাজটা করতে গিয়ে প্রতিবারই আহত ও অসুস্থ হই হালকা। সামান্য ভারী জিনিষও টানা ডাক্তারের বারণ অনেক দিন। বুড়ো হয়ে গেছি। কিছু করবার নেই।

প্রতিবারই বাসা বদলানোর সময় পুরনো জিনিষ বেরিয়ে পড়ে, একগাদা স্মৃতিসহ।
একটা বুলগেরিয়ান পুতুল। এক বুলগেরিয়ান বন্ধু দিয়েছিলো বছর ছয়েক আগে কোন এক বিদায়ের মুহূর্তে। এক সাথে জাপানি শেখার ক্লাস করতাম। না, মেয়ে বন্ধু নয়। সেই ছেলেটার ছবি দেখলাম কাল ফেইসবুকে অন্য এক বড় আপুর অ্যালবামে। কোন একটা প্রোগ্রামে হাত নাড়িয়ে কী যেন বলছে। হড়বড় করে হাত নাড়িয়ে অভিনয় করে কথা বলার অভ্যাস ছিলো ছেলেটার। অনেকদিন যোগাযোগ নেই।

একগাদা চিঠি। সবই দেশ থেকে। আবারও হতাশ করি। না, কোন মেয়ে বন্ধু নয়। আমার খুব কাছের এক বন্ধুর চিঠি লেখার অভ্যাস ছিলো। তার চিঠি। সাহিত্যমান হয়তো যুতসই নয়। সবই রাখা আছে। জিনিষপত্র বাঁধতে গিয়ে প্রচন্ড ক্লান্ত কোন মুহূর্তে এক সময় মনে হলো, ফেলে দিই ট্র্যাশে। আবার যত্ন করে রাখলাম একটা প্যাকেটে। কোন একটা চিঠিতে লেখা ছিলো, আল্লার মাল আলতাফ এর গল্প। রাজনৈতিক মন্তব্য। বন্ধুর নিজের গার্লফ্রেন্ডের গল্প। অথবা স্কুলজীবনের কোন এক স্যার মারা গেছেন, সেই খবর। এসব খবর ফোনে পেতাম। অথচ, আবার যত্ন করে সে চিঠিতে লিখতো। আমিও লিখতাম, যতোটা পারি। শেষ চিঠিটা আসে বছর দেড় আগে। বন্ধু অসময়ে বিয়ে করে বসে অথবা করতে হয় বাধ্য হয়ে। তারপর গৃহী হয়ে যাওয়া সেই বন্ধুর কাছ থেকে কোন চিঠি আসে নি। যোগাযোগ ছিলো। ফোনে।

আরো বেরিয়ে পড়লো, দুটো বই। একজন অতিমানবী, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আরেকটা চার্লস ডিকেন্সের বাংলা অনুবাদ। ভিতরের পৃষ্ঠায় লেখা, আমাদের প্রিয় শিক্ষক কে বিদায়ের মুহূর্তে- তারপর দুটো নাম লেখা। দুটোই মেয়ের নাম। একটা সময়ে বড্ড টাকার প্রয়োজনে কোচিং করাতাম, টিউশনি করাতাম। কোচিং এর ছাত্রীই হবে। মেয়ে দুটোর মুখ আবছা মনে করতে পারছি। আহা, কতকাল কেউ কোন উপহার দেয় না।

পুরনো পাসপোর্ট সাইজের ছবিও বেরিয়ে আসে অনেক। খুব শুকনোপটকা আরেকটা সাদাকালো আমি যেন ছবিগুলোর ভিতর থেকে হাসতে থাকে। স্মৃতিকাতরতাকে উপেক্ষা করি এবার। সবগুলো ফেলে দিই ট্র্যাশে, দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে।

স্মৃতির কি আদৌ কোন সত্যিকারের মূল্য আছে?
এইরকম করে সাথে যা স্মৃতিচিহ্ন বয়ে নিয়ে এসেছি, তাও হয়তো আগামী আরো অনেক বছর কোন বাক্সে ঘুমিয়ে থাকবে কিংবা কোন বইয়ের তাকে ধুলোর সাথে মাখামাখি করে পড়ে থাকবে নিতান্তই অবহেলায়। আবার বাসা বদলানোর প্রয়োজন পড়বে যখন, আবার বেরুবে, আরেকবার ট্র্যাশে ফেলার বিবেচনায় আসবে। হয়তো পুতুলটাকেও ফেলে দেবো, চিঠিগুলোও ফেলে দেবো। খুব বেশি দূরত্বে যেতে হলে হয়তো বইগুলোও ফেলে দেবো। স্মৃতির চেয়ে জিনিষপত্র হালকা করাটা বেশি বাস্তবসম্মত মনে হবে তখন। স্মৃতির সাথে ছাড়াছাড়ির শোকের আয়ু এই সময়ে বড্ড কম। একটা ব্লগ লেখার জন্যে যতটুকু সময় দরকার তার থেকেও কম।

১৩টি মন্তব্য:

. বলেছেন...

এই ঘর, ঐ ঘর। অন্য কোনো ঘরে...

আলী মাহমেদ - ali mahmed বলেছেন...

সবিনয়ে, আপনার সঙ্গে অমত পোষণ করি। আমার ধারণা, স্মৃতি আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। নইলে কবেই মরে ভূত হয়ে যেতাম- একেকটা চলমান লাশ!

দৃপ্ত বলেছেন...

লেখা পড়ে নষ্টালজিক হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

ইউ আর মেকিং এ ক্লাস - আরণ্যক!

রায়হান আবীর বলেছেন...

আপনার লেখা মিস করি। এই লেখাটা পড়ে আরও মিস করলাম। ভালো থাকবেন।

. বলেছেন...

সৌরভ,
চলে যাওয়া সময় কি আমরা ফিরে পাই?
আজ আমার ব্লগস্পটের স্ট্যাটকাউন্টারে গিয়ে দেখলাম Milwaukee Wisconsin United States থেকে কোন একজন ৬৪ বার গুতা দিয়েছে নানান পোস্টে। সেখান থেকেই গুতিয়ে গেলাম আড়াই বছর আগের লেখা আমার দিনলিপিতে। ভুলে যাওয়া সময়, সময়ের অনুভূতি যেনো আমার দিকে মুচকি হাসছে, বলছে - এভাবে ভুলে গেলে সব?

ভুলে যাবো জানতাম বলেই, লিখে রাখা ওসব সান্ধ্যলিপি।

আপনার কি মনে হয় না, অনুভূতিশুন্য মানুষটির আরো অনুভবগুলো জগতে জানানো উচিত। অন্ততঃ আমার মত পলায়নপর স্মৃতিকাতর অনলাইন বন্ধুর জন্য? পড়শীর ঘরেই তো আশ্রয় নেয় মানুষ। পাখি ঘরে ফেরে, আর মানুষ?

ani বলেছেন...

লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো | আমারতো পুরানো ড্রয়ার তাক খুঁজতে খুঁজতে ডায়রি, খাতা ... মন উদাস করার চিহ্ দেখতে দেখতে সুখ দুঃখের টানাপড়েন চলে | এটাই |হয়তো জীবন

বোহেমিয়ান বলেছেন...

আর লিখছেন না কেন?
ছুঁয়ে গেল লেখাটা

রাশেদ বলেছেন...

আর লিখবা না?

সাজ্জাদ রহমান বলেছেন...

ভাল লাগা রেখে গেলাম।

Christian Jenny বলেছেন...

ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

Banglanews বলেছেন...

আমার খুব ভাল লেগেছে। আপনার কথার সাথে একমত।

all newspaper list বলেছেন...

ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

ছোঁয়া বলেছেন...

হঠাৎ কষ্ট জেগে উঠল মনের মাঝে ...