মঙ্গলবার, অক্টোবর ২৮, ২০০৮

মনোলগ - যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে

আমার মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করে। খুব নিঃশব্দে, কাউকে না জানিয়ে, অথবা কারও জন্যে কোনওভাবে বিরক্তির তৈরি না করে। আমার চলে যেতে ইচ্ছে করে, যেন আমার জন্মই হয় নি অথবা আমার কোন অস্তিত্বই ছিল না। যেন আমি কোন পথ হাঁটি নি, যেন আমি কোনও পায়ের ছাপ রাখি নি কোথাও। যেন আমি লিখি নি কোন গল্প, অথবা গাই নি কোন গান। নিভৃতে, কারও জেনে ফেলার আগেই, মুছে ফেলতে ইচ্ছে করে ভুল করে তৈরি করে ফেলা আমার অ্যাকাউন্ট।

মরে যাবার আগে, আমার একটি বারের জন্যে ইচ্ছে করবে না কারও মুখচ্ছবি মনে করে সামান্যতম দুঃখবোধে সিক্ত হ'তে অথবা কারও কণ্ঠধ্বনি শুনে - পৃথিবী আসলে বড্ড ধোঁয়াটে সুন্দর - সেই কথা দ্বিতীয়বারের জন্যে ভাবতে। হোক সে আমার জননী, যার কাছে আমি নিতান্তই নিরুপায় ক্ষমাপ্রার্থী হবো হয়তোবা আমার অসহায়তার জন্যে, অথবা জনক কিংবা আনন্দময় শৈশবের জন্যে সবসময় কৃতজ্ঞ থাকা হারিয়ে ফেলা বন্ধুটি। হয়তো আমার ইচ্ছে করবে না আরেকবার নিজের এই সামান্য সময়ের ভন্ড জীবনটুকুর জন্যে কোন অতৃপ্তিবোধে আচ্ছন্ন হতে।

কিন্তু,আমি যেহেতু মফিজ, জয়নুল, ছগিরুল অন্য সবার মতোই খুব স্বাভাবিক, খুব গুডি বয়দের মতোন ম্যাঁদামারা জীবন যাপন করে এসেছি। এবং আমি মহামানব নই, নই সামান্য প্রতিভাবানও। তাই, হয়তো জেগে উঠতে পারে সামান্য লোভ, তুচ্ছ মনের কোন এক কোণে। ইচ্ছে করতেও পারে জীবনকে কখনোই ভালোবাসতে না পারার ব্যর্থতাটুকু নিয়ে আরো কিছু ক্ষণ, কিছু পল অর্থহীন ভাবনা রচনা করার চেষ্টা করতে।

হয়তো ইচ্ছে করে বসতে পারে, আরেকবার হেঁটে যেতে চিরচেনা পথ ধরে আমার শৈশবের পাঠশালায়। অয়ন নামের একজন প্রিয়জন কাল মনে করিয়ে দিলো, আমাদের স্কুলের মাঠটা অনেক বড় ছিলো। সেই মনে করিয়ে দেবার সূত্র ধরে কিছু নিউরন উত্তেজিত হয়ে, মনে করার দরকার নেই এরকম স্মৃতিকে, ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে পারে।

শেষবারের মতো আমার মনে পড়তে পারে, বয়েস পাঁচে আমি একবার লাঙল দেয়া জমি ধরে দৌড়ুতে গিয়ে উল্টে পড়ে গিয়েছিলাম। পুরো গায়ে ধূলো মেখে বাড়ি গিয়ে মা-কে কী বলবো, এই ভেবে সারা গায়ে থুথু মেখে বসেছিলাম। আমার মনে পড়তে পারে, শৈশবে আমার রাগী মা কখনো মারলে অথবা বকলে আমি মাটিতে গড়াগড়ি দিতাম মার খাওয়ার আগেই। অথবা শেষবারের মতোন আমার মোটামুটি নির্ভরযোগ্য স্মৃতিশক্তি মনে করে বসতে পারে, কীভাবে ছুড়ে দেয়া ধাতব পাত্রের আঘাতে সহোদরের একটা দাঁতের অংশবিশেষ ভেঙে দিয়েছিলাম - সেই স্মৃতিও। আমি কখনোই ক্ষমা প্রার্থনা করি নি তার কাছে সেই অপরাধের জন্যে। এখনো তার সেই দাঁতটি সেই অবস্থাতেই আছে, যতদূর মনে পড়ে।

এইসব ফ্লাশব্যাক আমাকে ভাবাতে পারে, বিরক্ত করতে পারে। তবুও আমার মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করে খুব কোনওরকম পিছুটান ছাড়াই। সবকিছুকেই অতিক্রম করে চলে আসলে যে শূন্যতা থাকে, তাকে স্পর্শ করার মতো সাহস যখন হয়ে যায়, তখন মুক্তির প্রত্যাশাই অনেক বড় হয়ে ওঠে।

এতোকিছুর পরেও আমি বেঁচে থাকি নির্লজ্জ্বের মতোন। আমিও আরেকজন মফিজ অথবা রহিম-করিম, রাম-যদু-মধু। আপনার অথবা তার মতোন আমিও স্বপ্ন দেখি, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী পাঁচ-ছয় মাসে আমি আরেকটা ডিগ্রী নিজের রিজিউমিতে যোগ করার সুযোগ পাবো। তারপরে পুড়ে যাওয়া অর্থনীতির দুর্যোগের সময়েও হয়তো কর্পোরেটদের দাসত্ব করবো কোথাও।

এইভাবে আপনার মতোই আমিও বাঁচি।
আগামীকাল অথবা আগামী মাস কিংবা আগামী বছরও হয়তো বেঁচে থাকবো।
তবুও এইসব সময় যখন আসে, তখন ভেবে পাই না, আসলে কী করা উচিত। আমি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে উঠি, আমি তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর হয়ে যাই। আমার কানে বাজে সেই গান আর কান্না - সব যে হয়ে গেল কালো, নিবে গেল দীপের আলো, আকাশ-পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে?

-
গান, যে রাতে মোর দুয়ারগুলি
"মেঘে ঢাকা তারা" ছবি থেকে, দেবব্রত বিশ্বাস ও গীতা ঘটকের কণ্ঠ

বুধবার, অক্টোবর ১৫, ২০০৮

লিখতে না পারার গল্প

অনেকদিন কোন অক্ষর যোগ হয় না এই খাতায়। খাতাটা খোলাই হয় নি অনেক দিন। কেনো লিখি না? নিজের সবচেয়ে আপন জগত, নিজের সবচেয়ে বড় আশ্রয়ের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াই কেনো?

লিখতে তো পারি, ডানা ভেঙে যাওয়ার কিংবা পুড়ে যাওয়ার গল্প।
ঈশ্বরে বিশ্বাস হারানোর গল্প। মুক্তির খোঁজে পঁচা-মরা নদীর পাশ দিয়ে খালি পায়ে তেলাপোকা আর ইঁদুর চড়ে বেড়ানো নীরব রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়ার গল্প। কিংবা মাঝেমাঝেই বিরক্ত করা - শৈশবে ডুবে যাওয়া শহরে হাঁটু পর্যন্ত স্কুলড্রেসের খাকি প্যান্ট গুটিয়ে, ফতুয়া ভিজিয়ে বাড়ি ফেরার নস্টালজিয়া।

তাহলে বাস্তব পৃথিবী নিয়ে লিখলেই তো হয়?
অসুস্থ মায়ের পাশে থাকতে না পারার ব্যর্থতা, কিংবা নিজের থেকে আরো বেশি করে পুড়তে থাকা আত্মজনের বিপদে কোন কাজেই না আসতে পারার পৌনঃপুনিক বেদনাগুলোর কাছে পরাজিত হওয়ার কথকতা। নিজের প্রিয় খাতায় এইসব আসে না কেনো? তবে কি নিজের কাছ থেকে নিজেই পালিয়ে বেড়াই?

প্রতি মুহূর্তে শরীর আর মনের ভারে বৃদ্ধ হয়ে উঠি - সেইটুকু এমনিতেই বুঝি। তাতে কী হয়েছে, মনে মনে ঠিকই শব্দ সাজাই, কিন্তু ব্যস্ততা এসে লেখাগুলোকে মুছে দেয়। নিজের আত্মার আলোটুকুর বিনিময়ে দাসত্ব অর্জন করার পথে এগুতে থাকি। রোজ ঘুমুবার আগে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবি, কালকের রোদমাখা দিনটায় হয়তো নতুন করে জন্মাবো, নতুন করে । হয় না, পারি না। মেঘ আর বৃষ্টি এসে কাঁচকলা দেখায় আমার সে চাওয়ায়।

ঘরের মাঝখানে বড়ো বাতিটা এখনো জ্বালানো হয় না। খুব স্বাভাবিক বাস্তব চিন্তা করি, আগামীকাল সন্ধ্যেতে অথবা মধ্যরাতে ঘরে ফিরে হয়তো ওই বাতিটা জ্বালিয়ে দেবো। পারি না, কিচেনের অংশের হালকা ৩৬ ওয়াটের বাতির আবছা অন্ধকারেই ভালো লাগে, নিজের সাথে নিজের দেখা হয় না তাতে।

প্রলাপ শেষ করে ফেলবো ভেবেছিলাম। শেষ করতে পারি না। সেই পুরনো বৃত্তটা থেকে বেরুতে পারি না।