রবিবার, আগস্ট ২৪, ২০০৮

অপলাপ এবং মৃত ঈশ্বর

মাথাব্যথা কয়েকদিন ধরে। মাথাটিপে ধরে সস্তার দোকানে প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনা পেইন-কিলার গিলে দিন পার করি। ডাক্তারে অরুচি। নিজের জন্যে এতো ভাবতে ইচ্ছে করে না। নরক বলে যদি কিছু থাকে, তবে সেখানে যেতে রাজি আছি, এই মুহূর্তে। জীবনে কোথাও কোন অতৃপ্তি নেই, কিংবা কোন অনুশোচনাও। বেঁচে আছি, তাই নানান লৌকিকতা এখনো করে যাচ্ছি।

-
কাল থেকে বৃষ্টি। গরম নেমে গেছে এক লাফে। কুলার দরকার হয় না। তবে, সাইকেলে চড়ে ছাতা নিয়ে বৃষ্টি মাথায় বেরুনো বেশ ঝামেলার। আইন বলে, ব্যাপারটা নিষিদ্ধ। মানে, সাইকেলে চড়লে ছাতা মাথায় দেওয়া যাবে না, ছাতা মাথায় দিলে সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে যেতে হবে। তবে, পুলিশে কিছু বলে না।
পুলিশে ধরে, সাইকেলে লাইট না থাকলে। আমার সাইকেলের লাইট ভেঙে গেছে, এক মাস হলো। আমার সাইকেলের সাথে গায়ে গা লাগানো নিজের সাইকেল বের করতে গিয়ে একজন সুবোধ মানুষ আমারটা ফেলে দিয়ে লাইট ভেঙে ফেলেছে। আমার সামনেই ঘটেছে। কিছু বলতে ইচ্ছে করে নি। মুচকি হেসে নিজের সাইকেলটা ঠিক করে রেখে, ভাঙা লাইটটা পকেটে ঢুকিয়ে ফিরে এসেছি।

সাইকেল নিয়ে ইদানিং বেশ ঝামেলায়ও আছি। ব্রেক কাজ করে না। গত পরশু গাড়ির সামনে আরেকটু হলে পিষে পড়ার উপক্রম হয়েছিলো। কীভাবে যেনো বেঁচে গেছি। গাড়িটা আস্তে চলছিলো, তাই ব্রেক করে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আইন বলবে, আমারই দোষ।


-
একটা বই পড়ছি, The Kite Runner। অনেকদিন পরে কিছু একটা মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। চেষ্টা করছি। নষ্ট হয়ে যাওয়া বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। অরুপ ভাইর পছন্দের বই। মাঝেমাঝে পড়ছি।

আফগান বংশোদ্ভূত লেখক খালেদ হোসাইনি র হাতে, আফগান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঝরঝরে ভাষায় গল্পের নির্মাণ। খালেদ এর বয়েস যখন আট, রাজা জহির শাহের পতন হয়। তার ডিপ্লোম্যাট বাবা পালিয়ে যান প্যারিসে, যখন খালেদ এগারোতে। পরে ইউএসএ তে, বাবার রাজনৈতিক আশ্রয়ের সূত্রে। সেখানেই কাটিয়ে দেন বাকি জীবন। যে জন্যে এই কথা বলছিলাম, বই এর যতটুকু পড়েছি, ততটুকু পড়ে কখনো মনে হয় নি ভদ্রলোক আফগানিস্তানে তার শৈশবের খুব অল্প সময় ছাড়া থাকার সুযোগ পান নি।

পুরো বই পড়া হলে লেখা হবে হয়তো বাকিটা।

-
বন্ধুহীন হয়ে পড়েছি। সময়েই সব বদলে যায়। সব মঞ্চ ভাঙে, পড়ে থাকে শুধু স্মৃতি। সব আড্ডার পাত্র-পাত্রীরা বদলে যায়, থাকে শুধু আড্ডার জায়গা। নতুনেরা আসে। ভাঙার জন্যে দরকার হয় একটা টুকরো ঘটনা অথবা উপলক্ষ্য। রাজশাহীতে নিউমার্কেটের ছাদে একসময় বসতাম। এখনো দুই বছরে একবার দেশে গেলে দেখি, নতুনেরা আড্ডা দিচ্ছে। পরিচিত কাউকে আর চোখে পড়ে না।

দেশ ছেড়েও সেলফোনের কল্যাণে কাছের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ ছিলো। সময়ে-অসময়ে ফোন করেছি একটা সময়। এখন সেই যোগাযোগ শূন্যের কাছাকাছি। প্রযুক্তির প্যাকেজে ড়্যাপ করে ফেলা বন্ধুত্ব এখন এক চিমটি এসএমএস, তিন ফোটা ফেসবুক, সামান্য ইন্সট্যান্ট মেসেজিং। ফেসবুকে কারও ছবি দেখে গতানুগতিক কপি-পেস্ট, "তোকে যা লাগছে নাহ"।

খুব কাছাকাছি সবাই মোটামুটি নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। চাকুরি,ক্যারিয়ার, কর্পোরেট জীবনে উপরে ওঠা, নিজের পার্টনার - আইনসিদ্ধ অথবা অসিদ্ধ, বিয়ে, ভাঙা-গড়া, কারও বাচ্চা-কাচ্চা এবং অন্যকিছু। তাই আর বিরক্ত করি না কাউকে। কার জন্যে কে সময় দেয়? কে এখন বন্ধু? বন্ধুত্ব এখন দিবস করে আসে। বাকি সব দিন সব্বাই একা। আদতে।
এইরকম করে মঞ্চ ভেঙে যায়। আমরা যেনো কয়েকদিনের জন্যে স্টেজ শো করতে আসা যাত্রার দলের ওয়ানটাইম অভিনয়ের পার্শ্বচরিত্র। পরের স্টেজ শো তে আর আমাদের দরকার নেই।
এইসবই এখন স্বাভাবিক, অথবা বাস্তব নিয়ম।

-
এইসব কেন লিখি? লোকের পড়ার জন্যে? নিজের অনুভূত কষ্টে লোকের সহানুভূতি চাইছি? মাঝেমাঝে নিজের ভন্ডামিকে নিজেই প্রশ্ন করে বসি। তবে, আজ স্বীকার করে যাই, হ্যা, আমি আসলে খুব ভন্ড। কোনটা যে আমি, আর কোনটা যে আমার অস্তিত্ব, আমি জানি না। এইসব কথা কাউকে কখনো বলা হয় না, তাই লিখে রাখি।

ভরা হাটের মাঝে কারও মেকি হাসিমুখ তার বর্তমান নয়, ভার্চুয়াল ব্লগে লেখা কারও সাজানো-গোছানো গল্পও পুরোপুরি সে নয়। পেসিমিস্টদের ঈশ্বর থাকে না, তাদের গল্পও এভাবে লেখা যায় না। পেসিমিস্টদের মন থেকে ঈশ্বর একটা সময় পরে আপনা আপনি মরে যায়।
সত্যি কথা বললে রূঢ় শোনায়, তবুও বলি, এইসব আগাছা হতাশাবাদী যতো তাড়াতাড়ি বিদায় নেয় এই বাস্তব ও আনন্দময় পৃথিবী ছেড়ে, ততোই জগতের মঙ্গল। পুরো জগত তাই মনে করে। যার সৌন্দর্য উপভোগের ক্ষমতা নেই, সৌন্দর্য প্রদর্শনী ছেড়ে চলে যাওয়াই সমীচীন। আমি জানি, আপনিও তাই ভাবেন। নয় কি?

অগাস্ট ২৪, ২০০৮

--
[কমেন্ট অপ্রার্থনীয়, সেজন্যে ক্ষমা চাইছি।
ছবি কৃতজ্ঞতা, ডেনিস কোলেট, কপিরাইট - সিসিএল ]

সোমবার, আগস্ট ১৮, ২০০৮

বিক্ষিপ্ত গল্প, একঘেঁয়ে সুর, জীবনের সরলরেখা

১।।
ইনসমনিয়া আবার এসে ভর করেছে। অনেকদিন পর। ঘরের পর্দা টেনে দিয়ে, আলো বন্ধ করে, টিভি ছেড়ে দিয়ে শুয়ে থাকি। ঘর ঠান্ডা করে, একেবারে ২৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নামিয়ে এনে, কাঁথা মুড়ি দিয়ে। বড় ধরনের বিলাসিতা। টিভিতে অলিম্পিক পদকজয়ীদের নিয়ে উচ্ছ্বাসভরা সব অনুষ্ঠান দেখি।

সাঁতার, জুডো, মেয়েদের রেসলিং এ জাপান কয়েকটা পদক জিতে বাকিসব ইভেন্টে ডাব্বা মেরেছে। এখনো ডাব্বা মেরেই যাচ্ছে। আমাদের ডলি আক্তার আর বিউটি নাজমুন নাহারকে এদের মতোন বেতন আর সুযোগ-সুবিধা দিতে পারলে নির্ঘাত কিছু না কিছু করেই ফেলতো।

চীনের জয়জয়কার দেখতে দেখতে বিরক্তি ধরে গেছে। তবে, এথলেটিকসে মজা পাচ্ছি। ১০০ মিটার দৌড়ে জ্যামাইকা র উসাইন বোল্ট এর দৌড় দেখে হাসবো, না কাঁদবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেই ভদ্রলোক অর্ধেক পথ দৌড়ে এসেই খুব একা একা বোধ করতে থাকে, ডানে তাকায়, বামে তাকায়, যখন দেখে তার সামনে কেউ নেই, ডানে-বামে তো নয়ই, সেই আনন্দে ফিনিশিং লাইন পার না হতেই নাচা শুরু করে দেয়।


২।।
সব অভিজ্ঞতাই কেমন যেন দেজাভ্যুঁ হয়ে যাচ্ছে আজকাল।
আন্ডারগ্রেডার ছিলাম যখন, তখনও লম্বা সময় শারীরিক অসুস্থতার জন্যে এইরকম টিভি ছেড়ে দিয়ে শুয়ে থাকতাম। পুরনো নাটক বা অনুষ্ঠান মাঝরাতে পুনঃপ্রচার করতো, মাঝেমধ্যে সেইগুলোতে মনোযোগ দিয়ে সব ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম। সকালে অবশ্য তখন ক্লাস থাকতো। ওইরকমভাবেই সকাল হয়ে যেতো, সকালে দু-এক ঘন্টা ঘুম আসতো মাঝেসাঝে।

সেইটা পার করে ক্লাসে হাজির হয়ে যেতাম ঠিকই সময় মতো। সকালের ক্লাসে কদাচিত ঘুমিয়েছি। আমার পাশে বা সামনের জাপানি বন্ধু নাক ডেকে ঘুমিয়ে গেছে বোরিং টিচারের পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইডের দিকে মনোযোগ দিতে না পেরে। আমি পারতাম না। ঠিকই জেগে থাকতাম চোখ টানটান করে। আমার ঘুম আসতো দুপুরের পরের ক্লাসগুলোতে। বাঙালির ভাত-ঘুম।
ক্লাসে শেষের দিকে টেস্ট বা হোমওয়ার্কের কথা উঠতেই নাক ডাকতে থাকা বন্ধু ঠিকই জেগে উঠতো অবশ্য। এই গুণটা অবশ্য আমিও রপ্ত করে ফেলেছিলাম পরে।


৩।।
শরীরটা অন্যদিক দিয়ে বিট্রে করে বসছে। পাকস্থলী কথা শুনছে না। সোজা বাংলায় বললে, পেটের সমস্যা।
পরিপাকযন্ত্রের গোলযোগের ব্যাপারটার সাথে আমার সখ্যতা খুব বেশি ছিল একটা সময়ে, দেশে থাকতে। ইলিশ মাছ খেলে পেট বিট্রে করতো, বাইরে সিঙারা-পুরি হাবিজাবি খেলে পেট বিট্রে করতো। গরীব শরীরে রাজকীয় পরিপাকযন্ত্র। তবে ব্যাপারটা যে জীবাণুর সাথে আমার শত্রুতাঘটিত, সেটা আমি পরে নিশ্চিত হয়েছি। কিছু কিছু সহজ সরল জীবাণু আমাকে খুব সহজে আক্রমণ করে বসতো।
গত বছর সাতেক এরকম হয় নি। হঠাৎ করেই অনিয়ম। আপাতত উপায় হলো, খাবারে মসলা বা মসলাযুক্ত খাবার বাদ দেয়া। খুব সহজ ব্যাপার। জাপানী খাবারে মসলা থাকে না।

৪।।
গবেষণা নিয়ে ভেজালে আছি। কিছু ডেটা বের করতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে।
কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিম্যুলেশন জিনিষটা বড্ড ভেজালের। একটা ফ্রি-সোর্স সিম্যুলেটর আছে, সবাই ব্যবহার করে, এনএস২ নামে। একে টানাটানি করে বাগে আনা খুব কষ্টের কাজ। পুরো সিম্যুলেটরটাকে ঠিকমতো না বুঝে একে দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতোন কাজ করিয়ে নেয়া অসম্ভব। এই ভেজালে আটকে আছি কয়েকদিন।

৪।।
খুব খুঁতখুঁতে হয়ে গেছি। মন-মেজাজ খুব খারাপ থাকে।
ল্যাবে পিচ্চিপাচ্চি, মানে জুনিয়রগুলো রোজ রাতে বাসায় ফেরার সময়, কুলার বন্ধ করতে ভুলে যায়। সেজন্যে আল-গোর এর একটা খুব ভয়ংকর বড় ছবি খুঁজে বের করেছি ওয়েব ঘেঁটে। "মাঝরাতে ঘরে ফেরা বন্ধু, কুলার বন্ধ করতে নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি" লিখে, পোস্টার আকারে প্রিন্ট করে ল্যাবের দরজায় সাঁটিয়ে দিয়েছি।

সত্যজিত রয় এর খুব ছোট ছোট গল্পের সংকলন ছোটবেলায় পড়তাম। এবারও বারো, একডজন গপ্প, এইরকম হতো নামগুলো। সেইরকম কোন একটা সংকলনে একটা মজার গল্প ছিলো, এক লোক মানুষের ভবিষ্যৎ ছবি এঁকে দিতে পারতো, সেই নিয়ে।

কয়েক সপ্তাহ ধরে ভবিষ্যত নিয়ে ভাবছি। না, সিরিয়াস কোন চিন্তা নয়। নিজের ভবিষ্যৎ ছবি কেমন হতে পারে, সেই নিয়ে। চিন্তা করলে একটাই ছবি ভেসে ওঠে, একটা খুঁতখুঁতে নিয়মতান্ত্রিক, একগুঁয়ে বুড়ো। মাথায় নির্ঘাত একটা পৈতৃক টাক। তবে ভুঁড়ি নাও থাকতে পারে। কারণ, তেল-চর্বি বড় অপছন্দের জিনিষ।

৫।।
পৌনঃপুনিকতা বড্ড বাজে জিনিষ। জীবনে কোন গল্প নেই। এখনকার জীবনটাকে একটা সরলরেখা হিসেবে চিন্তা করে, সময়নিরপেক্ষ যে কোন একটা অংশ তুলে নিলেই পুরো জীবনের রেপ্লিকা পাওয়া যাবে।
কোন গল্প নেই, কোন বিশেষ ঘটনা নেই।
বড্ড খারাপ, বড্ড খারাপ।

-
অগাস্ট ১৮, সোমবার, ২০০৮