রবিবার, জুন ২২, ২০০৮

বৃষ্টি ও নির্বাসনের চিরাচরিত গল্প

আজ সারাদিন বৃষ্টিতে ঘরে আটকা পড়ে আছি। আটকা পড়ে আছি - বলছি এইজন্যে যে খুব একটা দরকার না থাকলে এই বৃষ্টিতে বোকারাই বাড়ি থেকে বেরোয়। এখনো ঝরে যাচ্ছে অবিরাম। রাত একটু বেশি হলে দৌড়ে আসি আধাঘন্টা ময়লা নদীটার পাশ দিয়ে। গুগল ম্যাপে খুঁজে দেখি সেই নদী ধরে চার-পাঁচ ঘন্টা দৌড়ে গেলে নদীর সাথে সাগরে মেলার জায়গাটায় পৌঁছুনো যাবে।
দৌড়ে এসে শাওয়ার নিয়ে শুয়ে পড়ি। রোজকার রুটিন। বৃষ্টির জন্যে আজ সেটাও করার উপায় নেই। মাঝে বেরিয়েছিলুম ময়লা কাপড় কয়েন ড্রায়ার এ দেবার জন্য। ওয়াশিং মেশিন থেকে বের করে ঘরে শুকোতে দিলেও চলে, কিন্তু বাতাসে পানির ভাগ বেশি, তাই কিছু কয়েন খরচ করা।

টিভিটা বেজে যাচ্ছে অবিরাম। বকর বকর করে যাচ্ছে নিজের ইচ্ছেমতোন।
ছোটবেলায় আমরা যখন গ্রামে থাকতাম, দূরে চাকুরি করা আমার বাবা ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসতো, বাবার সাথে থাকতো একটা রেডিও সবসময়, সম্ভবত সনি কোম্পানির বানানো। সেই রেডিওটায় শোনা যেতো রংপুর থেকে রিলে করে শোনানো ঢাকার অনুষ্ঠান অথবা শিলিগুড়ি বা কলকাতা থেকে প্রচারিত বাংলা খবর আর গান।
জলচৌকি পেতে আমার বাবা বসে থাকতো সন্ধ্যায়, জলচৌকিতে আরো থাকতো মুড়ি-কাঠাঁল অথবা আম।
সেই রেডিওটা বেজে যেতো বোকার মতোন। এইরকম করে।

টিভির শব্দে কান যায় না। ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। অনেকটা সময় পেরিয়ে এলাম এইভাবে ছাদের দিকে তাকিয়ে। ছেলেবেলায় খাটের নিচে ঢুকে শুয়ে গল্পের বই পড়তাম, তিন গোয়েন্দা, সুনীল অথবা সমরেশ। ছাদটা অনেক কাছাকাছি ছিলো। এখন যে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে সেটা বড্ড দূরে। ছেলেবেলায় বাবা ছিলো, একটা পরিবার ছিলো। এখনো সেইসব আছে, সুতোছেঁড়া, বাবা আছেন, পরিবার থেকেও নেই। দূরত্ব অনেক বেশি। অনেকদিন নিজেই নিজের মাথার ছাদ। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক টাকা না থাকলেও কোন চিন্তা নেই।

সপ্তাহ পাঁচদিন স্কুলে আসি, থিসিস এর কাজ করি, সেমিনার চালাই, জুনিয়রদের বকাবকি করি, নিজে আবার নিজের অ্যাডভাইজরের ঝাড়ি খাই। বসে বসে য়্যুটিউবে পুরনো দিনের গান খুঁজে বের করি। পার্টটাইমের সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারকে রেগেমেগে মেইল করি, তোমার কাজ আমি করি না, তোমার ডেটাবেজ স্কিমা কে তৈরি করসে, মাথা নাই মুণ্ডু নাই তার। অনেকদিন কোন ভালো লেখাও লিখতে পারি না। কয়েকটা লেখা পড়ে আছে গুগলডকে, বের হবে না কোনদিনই মনে হয়। সৃষ্টিশীল চিন্তা করার অংশটুকু সম্পূর্ণ অচল হবার পথে।
রাত বারোটায় বাড়ি ফিরি। কেটে যায় দিন, কেটে যায় পথ। নিজে থেমে গেলেও দিনগুলো যাবে।
যেন ছুটে যায় ট্রেন, হুইসেল দিয়ে। আমি থেমে থাকলেও ট্রেনের কিছু যায় আসে না। ট্রেনের সাথে তাল রেখে আমাকেও দৌড়ুতে হয়।

একটা লুপে পড়ে আছি মনে হয় মাঝে মাঝে। রোজ এক দোকানের এক স্যান্ডউইচ খাই, একটা স্যান্ডউইচ আর একটা অ্যাপল পাই, গুণে গুণে একই দাম দিই, ৪৪১ ইয়েন। রোজ এক গান শুনি, লতা মুঙ্গেশকর অথবা নুসরাত ফতেহ আলী খান, রোজ ভাবি - আইপডের গানগুলো বদলাতে হবে, করা আর হয়ে ওঠে না। রোজ একপথে একই জায়গায় পায়ের ছাপ রেখে যাই। রোজ এক জায়গায় একই পথচলতি মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায়, হেসে ফেলি।

উড়ে যায় পুরো সপ্তাহটা এইভাবে।
আর এইরকম বৃষ্টিবন্দী দিনে সারা সপ্তাহ গলায় চেপে রাখা ক্কান্নাটুকু বেরিয়ে আসতে চায় । ঈশ্বরের সাথে এমন কোন বন্ধুতা নেই যে, তাকে ডাকবো প্রাণভরে। তবু মাঝে মাঝে তার সাথেও বন্ধুতা করতে ইচ্ছে করে । ভাবি, বলি,
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে---
এখন আমারে লহো করুণা ক'রে


*জুন ২২, রোববার*, ছবি কৃতজ্ঞতা, (সিসিএল এর আওতায় ব্যবহার)