বুধবার, ফেব্রুয়ারী ১৩, ২০০৮

দহনগল্পের আরেকটি পাতা

১.
হঠাৎ করে ঘোড়া হয়ে গেছি।
রোববার সকালে ওভেনে রুটি ঢুকিয়ে দিয়ে ডিম ভাজতে যাবো, সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম, কী যেন পারছি না। কোন একটা নড়াচড়া পারছি না, অনেকক্ষণ পরে খেয়াল হলো, কথা শুনছে না ধড়ের উপরের একমাত্র মাথা। ডিম ততক্ষণে হাত থেকে পড়ে গেছে মেঝেতে, মুখ দিয়ে অন্যসময়ের মতো "শীট..ট" বলে উঠে নিজের মনেই হেসে ফেলেছি। মাথা নড়াচড়া করতে পারছি না, সেই অবস্থায় এই ময়লা পরিস্কার করতে হবে সেই ভেবে।

পরে যা বুঝলাম, শুধু সামনে তাকাতে পারি, ধড়ের উপরে মাথাটা ডানে-বামে করতে পারিনা। উপরে-নীচেও নয়। শুয়ে পড়লাম চুলা নিভিয়ে দিয়ে। বিছানা থেকে ওঠার সময় মাথাটাকে ভারী মনে হতে থাকে। গলার পিছনের মাংসপেশীগুলো বিদ্রোহ করে বসে। বাম হাতটায় সামান্য অবশ অনুভূতিও। নিজের ধারণ করা শরীরের বিদ্রোহের সব অনুভূতির সে এক অপূর্ব সমন্বয়।

কিন্তু, হঠাৎ করে মনে হচ্ছে, এই অনুভূতিগুলো খুব পুরনো, বয়েস যখন চার-পাঁচ, তখনকার স্মৃতি যেনো আবার চক্র ঘুরে ফিরে এসেছে।
সেই ছোটবেলায়, বাবার কোলে বসে, চারপাশে অনেক মুখ। ডাক্তার বলছে, বাবা, মাথা বামে-ডানে করো তো, আমি বামে-ডানে করি, উপরে নিচে করো তো, আমি উপরে-নিচে মাথাটাকে দুলিয়ে যাই। আমার মাথায় ঢোকে না, সমস্যাটা কোথায়। সবাই চারপাশে কেনো?
সেবার মেনিনজাইটিস হয়েছিলো। তবে এবার?
ঈশ্বরকে মাঝেমাঝে খুব মজার রম্যনাট্যকার মনে হয়।

২.
বাইরে ভীষন বাতাস, এই ঠান্ডায়। সারাটা দিন হালকা বৃষ্টি, বৃষ্টি থামবার পরে এখন আবার শুরু হয়েছে বাতাস। কাল রাতে এক ঝুড়ি কাপড় ধুয়ে ছাদে নেড়ে দিয়েছিলাম। সকালে উঠে আর মনে ছিল না, বৃষ্টিভেজা দিন পার করে এতক্ষণে খেয়াল হলো। যাই, কাপড়গুলো আবার মেশিনে দিয়ে আবার শুকোতে হবে।

৩.
আজ একটা লম্বা দিন গেলো। উঠেছি সাতসকালে, দুদিন নিজের বানানো চিকিৎসায় ব্যথা কমছে বলেই মনে হলো। চিকিৎসা বলতে রোক্সোনিন, একগাদা পড়ে ছিলো বাসায়, পুরনো অসুখের রেশ হিসেবে, তার সদ্ব্যবহার করলাম। আমাদের বাংলাদেশের ক্লোফেনাক ধরনের ওষুধ। আর কুলিং প্যাড।
ডাক্তারের কাছে যাবো কি যাবো না, সেই ব্যাপার নিয়ে ভাবতে গিয়ে ঘুমিয়ে নিলাম আরো আধাঘন্টা।
হাসপাতালে গেলে বসে থাকতে হবে নির্ঘাত পুরো সকাল। নাকউঁচু হাসপাতালের এই এক বড় সমস্যা। সেই বিরক্তির কাছে এইসব ব্যথা আর ঘোড়ার মতো হয়ে যাওয়া কোন ব্যাপার ই নাহ।
গেলাম তারপরও। নিজের সবসময়ের ডাক্তারকে আজকে পাওয়া যাবেনা, জেনেও।

ভাগ্য ভালো, দুবছর আগে এই হাসপাতালে দুই সপ্তাহ কাটানোর সময় যে ডাক্তারটি আমার দায়িত্বে ছিলেন, তাকে পাওয়া গেলো। দাঁত বের করে বললেন, পড়াশুনার কী অবস্থা।
আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, পড়াশুনা গোল্লায় যাক, আগে বলেন, ঘোড়া হয়ে গেলাম ক্যান?
এক ঘন্টা পরে একগাদা রেঁন্টগেন ছবি হাতে ধরে তাকে বেশ বিব্রতই মনে হলো। তারপর, চৌম্বকঅনুনাদ পদ্ধতির ছবি তোলার একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে সবসময়ের ডাক্তারের সময়ে গোল্লা মেরে দিলেন। আবার ঢুকতে হবে সেই চুম্বক সুড়ঙ্গে, ভাবতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

ফলাফল লিখতে ইচ্ছে করছে না।
হুমম, বিপদেরা আর ছাড়ে না মোরে। আপাতত, ডাক্তার আমার চিকিৎসাই আমাকে ধরিয়ে দিলো, রোক্সোনিন আর কুলিং প্যাড। হ্যান্ডল দ্য পেইন ফার্স্ট, তারপর অন্য কথা।

৪.
ছোটবেলায় আমরা গ্রামে থাকতাম, আমার ছয় বছর বয়েস পর্যন্ত। আমাদের বাড়ির সামনে গোরস্তান, আরেকটু পেরোলেই বড়সড় জঙ্গল। বাড়িতে এক দঙ্গল ভাই-বোন, বাবা নেই, চাকুরিতে দূরে একা, এপারে মা-কে একা সামলাতে হতো আধডজন বাচ্চা-কাচ্চা। তাও ভালো, নানা বাড়িটা ছিলো একটু দূরেই।

আমি জ্ঞান হবার পরে বেড়াতে যাওয়া ছাড়া আমাদের বাড়িটায় খুব বেশি থাকিনি। সেই বাড়ি ছাড়া আমাদের থাকবার আর কোন জায়গা নেই অবশ্য। খুব বেশি স্মৃতিও নেই সেই জায়গাটা ঘিরে। কিন্তু, সেইখানেই আমার শেকড়।
কোথাকার আমি, আর কোথায় পড়ে থাকি এই স্ট্রেসভরা ইটপাথরের জঙ্গলে।

কিন্তু, তবু কেন যেন সেই জায়গাটাই মনে পড়ে আমার, এইরকম সব দিনের শেষে, এইসব গান শুনলে।
যে গানটা এখন বাজছে আমার ঘরে।

"তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মনরে আমার?"