সোমবার, ডিসেম্বর ৩১, ২০০৭

কীভাবে লিখবো আমার শেষ কবিতাটি?

প্রাণহীন হয়ে পড়া নগরের যাপিত জীবনে, নিজের প্রাণেও মৃত্যুর ছোঁয়া অনুভব করি কয়েকটা দিন। সারাবছর চাবি দেয়া যন্ত্রের মতো চলতে থাকা, এই দেশটায় নিউইয়ার এর সামনে-পেছনে প্রায় এক সপ্তাহ যেনো শ্মশানের ক্লান্তির ছায়া নেমে আসে। নগরের নয়, এমন মানুষেরা সব্বাই বছরে একবার হলেও বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে, বছরের বারো মাস চাবিটেপা পুতুলের মতো দৌড়ে চলা মানুষগুলো সামান্য হলেও ভুলে থাকা শেকড়ে ফিরে নিজেকে নতুন করে পাওয়ার চেষ্টা করে সম্ভবতঃ। আত্মজনের সাথে এক টেবিলে এক গ্লাস বিয়ার গিলে সামাজিকতা পালনের চেষ্টাও করে বোধহয় কেউ কেউ।

এই শহরে কখনো বন্ধ না হওয়া সুপার মার্কেটও দুটো বা একটা দিন বন্ধ হয়ে যায়; সারাবছর দাড়িয়েও টিকতে পারা যায় না ট্রেনে, বসার সীটগুলো খালি পড়ে থাকে; সাবওয়ের রেলস্টেশনগুলোকে দ্বিমাত্রিক জগত থেকে উঠে আসা কোন পট বলে ভ্রম হতে থাকে। প্রাণের অভাবে, জেঁকে বসা শীত নগরকে আরো কামড়ে ধরে।

এইসব কিছুর মাঝে বছরের এইসময়ে মৃত আমি আরো মৃততর হয়ে উঠতে থাকি। অন্যসময়ে ব্যস্ততার প্রলেপে চেপে রাখা যন্ত্রণাগুলো এইসময়ে আমাকে পতিত করে তোলে।

এই সময়টায় স্মৃতিকাতর আমাকে, শীতল সব স্মৃতিরা আরো কুরে কুরে খেয়ে ফেলার চেষ্টা করে। মনে পড়ে, স্কুলজীবনে ডিসেম্বর মানে, পরীক্ষাশেষে পড়াশুনার চাপ ছাড়াই ইচ্ছেমতো সময় কাটানো, বকুনি খাওয়ার ভয় ছাড়াই যতক্ষণ ইচ্ছা টিভি দেখা, এ সপ্তাহের নাটক অথবা মঙ্গলবারের সাপ্তাহিক কিংবা রোবোকপ অথবা সিন্দবাদ এর বাংলা ডাবড ভার্সনে বুঁদ হয়ে থাকা। অথবা বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা তিন গোয়েন্দা কিংবা কুয়াশা র ভল্যুমগুলো নিয়ে লেপের নীচে ঢুকে পড়া। কিন্তু, ইদানিংকালে নতুন করে বুঝি, এইসব আবছা আবছা ধোঁয়ামাখা স্মৃতিরা সময়ের সাথে সাথে মুছে যেতে থাকে।

পেছনে পড়ে থাকা আমার শৈশব আরো পেছনে চলে যায়, দূরে সরে যেতে থাকে। এই ২৫ এর অবস্থান থেকে দেখলে আমার পুরো দেশটাই আমার পেছনে পড়ে যায়, খুব ছোট দেখাতে থাকে সবকিছু। খুব যে অবাক হই, তা নয় - ১৭ তে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাকটিক্যালগুলো শেষ হয়ে গেলো যেদিন - তার দুদিন পরেই ঘর ছেড়ে ঢাকা যাওয়ার বাসে উঠে বসেছিলাম কোচিং করবার জন্যে। সেই শুরু। তারপরে নিজঘরে, নিজভূমে অতিথি বাকিটা সময়।
তারপরে অনেকদূর, অনেক সময়। ঘরকুনো অন্ধকার অনুভূতিশূন্য কেউ একজন আমি অন্ধকার নির্বাসনকেই বরণ করে নিই জীবনের পরিণতি হিসেবে।

অস্বীকার করতে চাই না, আমার আমিত্ব অন্ধকার ভরা। হৃদয়ে আমি মৃত্যুর ছায়া দেখি প্রতিনিয়তই। আমি পরিবারের ভালোবাসার লোভে বাঁচতে চাইনা, কারণ আমি স্বার্থপর। ধর্মকে অবলম্বন করে বাঁচি না আমি অথবা, ধর্মহীন ঈশ্বরহীনতায়ও নয়, কারণ আমি ভন্ডামির ধারক।

আহ, আপনি নিশ্চয়ইআশা-র কথা বলবেন? তার সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, মধুচন্দ্রিমার আগেই।

এই পাতাটি পড়তে থাকা আপনি "The Shawshank Redemption" নামের একটা চলচ্চিত্র নিশ্চয় দেখে থাকবেন, তরুণ ব্যাংকার অ্যান্ডি তার স্ত্রী ও স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমিক কে হত্যার মিথ্যা অভিযোগে কুখ্যাত শশ্যাঙ্ক জেলে নিক্ষিপ্ত হবার পরেও শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসে নিজের চেষ্টার জোরে, অনেক নাটকীয় ঘটনার পরে। আশা ছিলো একমাত্র বস্তু, যা তাকে জেলের কুঠুরিতে রিটা হেওয়ার্থ এর এক বিশাল পোস্টারের পেছনে ছোট হাতুড়ি দিয়ে গোপন সুড়ঙ্গ তৈরির মতো অসম্ভব এক কাজে প্রেরণার জোগান দিয়ে যায়। এক আশা আর জেলে তৈরি হওয়া বন্ধুত্বের ভালোবাসার জোরে শশ্যাঙ্কের জেল থেকে অ্যান্ডি সুয়্যারেজ পাইপ দিয়ে হাটুমুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে মুক্ত বৃষ্টির অবগাহনে। অস্বীকার করবার উপায় নেই, নায়ক অ্যান্ডির চরিত্রে টিম রবিন্স এর মুক্তবৃষ্টিস্নান এর সেই বিখ্যাত দৃশ্যটি আবেগপ্রবণ যে কাউকে আপ্লুত করে তুলবে অবশ্যই।

অনেকদিন পর পরশু আবার দেখলাম এই চলচ্চিত্রটি। উহুহ... একে ধর্মবিশ্বাস বা নৈতিকতার তথাকথিত জয়, অর্থাৎ হ্যাপি এন্ডিং এর প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিচ্ছু বলে বোধ হয়না।

তাহলে এই ভন্ড আমি-র মুক্তি কোথায়? মৃত্যুতে?
বহুদিন আমার মূর্খ ও ভন্ডামি ভরা ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক এই নিয়ে বিব্রত বোধ করেছে। ধর্মকে বিশ্বাস করলে মৃত্যুতে মুক্তির কোন প্রশ্নই আসেনা, মৃত্যু আরেক নির্বাসনের দরজা সেখানে। ধর্মের ভিত্তি ছাড়িয়ে নিলে, মৃত্যু অসার এক "নাই" এর জগত। মৃত্যু সেখানে সত্যিকারের প্রস্থানপথ, শ্যামসম।

কোনওভাবে জীবনকে টেনেটেনে যাপন করার চেষ্টার থেকে "প্রস্থানপথ", আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হবার যথেষ্ট কারণ যেখানে উপস্থিত, সেখানে খুব সত্যি করেই ভাবতে ইচ্ছে করে, কীভাবে লিখবো আমার শেষ কবিতাটি?
কীভাবে রচনা করবো আমার শেষ গান?

বুধবার, ডিসেম্বর ২৬, ২০০৭

ডিপ্রেশন?

অন্য সব বছরের মতোই আরেকটা শীত। আরেকটা সৌরবর্ষের শেষ। নতুন বছরের আগমন। সেইসাথে ছুট্টি!
রাস্তায় কমে আসা মানুষের আনাগোনা, আশপাশের ব্যস্ত ও অতিউদ্যমী কর্মঠ মানুষগুলোর আত্মজনের কাছে ফেরা অথবা ব্যস্ততার মাঝে একটা ফুলস্টপ দেবার জন্যে, কিংবা কয়েকটা দিন জিরিয়ে নেবার জন্যে শেকড়ের মুখোমুখি হওয়া। অথবা, ছুটি উপভোগ করবার জন্যে উড়াল দেওয়া অন্য কোথাও।
আমার সেসব দলে থাকা হয়না কখনো। লুজারদের জন্যে এইসব নয়।
আমি ঘুম থেকে উঠি অনেক বেলা করে, ১০টা-১১টা। না করলেই নয় দুয়েকটা জব এন্ট্রি বা ওয়েব টেস্ট, সামান্য পড়াশোনা। কষ্ট চেপে একেকটা পৌনঃপুনিক দিন পার করা। ওয়েব সার্ফিং করিনা, ভাল লাগেনা ব্লগিং কিংবা ট্রলিং।

তাহলে ভয়ে ভয়ে থাকা ডিপ্রেশন শেষ পর্যন্ত?

মাঝেমাঝে আইএইচটিতে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমস এর কলামগুলো পড়তে বসি। আজ পড়ছিলাম মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ফ্রিডম্যান এর এই লেখাটি

উনি বলছেন - বছরের এই উৎসবের সময়টায় আমাদের অজান্তেই প্রাকৃতিক নিয়মেই লাখ লাখ মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগেন, নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে বসেন এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে গুটিয়ে নেন। যাকে বিশেষজ্ঞেরা সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার বা SAD বলে অভিহিত করছেন।

ফ্রিডম্যান আরো বলছেন, পুরো ব্যাপারটা আপনি কাটিয়ে উঠতে পারেন, গায়ে রৌদ্রজ্জ্বল সকালের আলো লাগিয়ে। বছরের এই সময়টায় ছোট হয়ে আসে দিন, কমে আসে রোদের তাপমাত্রা, স্যাড এ আক্রান্তদের মস্তিষ্কে অন্ধকারের সংকেত বাহক মেলাটনিন নামের হরমোনটির মাত্রা যায় বেড়ে। কয়েকটা দিন একনাগাড়ে সকালের আলো গায়ে লাগান, নেগেটিভ আয়ন গ্রহণের সুযোগ বাড়ান, কাজ হতে পারে।

হুহ, ফ্রিডম্যান যা বলেছেন, তাই সঠিক। তবে তার থেরাপি আমার জন্যে নয়। সংজ্ঞা অনুসারেই, আমি সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডারেও আক্রান্ত নই। সামথিং এলস মাস্ট বি রং উইথ মী।

শুক্রবার, ডিসেম্বর ২১, ২০০৭

আটপৌরে জীবনের চিরন্তন একাগল্প

১.
:: ডিসেম্বর ২১, ০৩:৩০ ::
ঘড়ির কাটা ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে রাত দুটোর ঘর, স্কুলের বড় গেটটা ছাড়া সব বন্ধ হয়ে গেছে, তাই বিরক্তির সাথে এই প্রায় শূন্য ডিগ্রি ঠাণ্ডার মাঝে, জোরে সাইকেলে প্যাডেল ঘুরিয়ে ঘুরপথে ছোট ঠিকানায় ফিরি। বাসায় ফিরে ল্যাপটপের সিডি ড্রাইভে বুট সিডি ঢুকিয়ে দিয়ে, পাওয়ার অন করে, শাওয়ার নিতে ঢুকি।
ল্যাপি বাবাজির কি যেন হয়েছে, ডিস্কের পাওয়ার খুঁজে পায়না, সিডি থেকে ডিভাইস ড্রাইভার লোড করে, অনেকক্ষণ পর রিস্টার্ট দিলে কাজ হয়, তাই শাওয়ারে ঢোকার আগে অনেকটা কাজ সেরে রাখি।

এই সিমেস্টারে যে তিনটা ক্লাস করতাম, তার একটার মিডটার্ম অ্যাসাইনমেন্ট এর ডেডলাইন কাল।
নতুন তারবিহীন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এর জন্যে জাপানে ২.৫ গিগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সি বন্টনের কাজ মোটামুটি শেষ। ওয়াইম্যাক্স নামের নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারবিহীন ব্রডব্যান্ড এর কাজের দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে কেডিডিআই আর উইলকম। কেডিডিআই র সাথে চিপদৈত্য ইন্টেল আছে, তাই বলাই বাহুল্য, তারা ওয়াইম্যাক্স ব্যবহারে এক পা এগিয়ে।

এই প্রেক্ষাপটে পরবর্তী তারবিহীন ব্রডব্যান্ডে আইএসপি, সেল ক্যারিয়ার আর ডিভাইস মেকার - কার অবস্থান কীরকম হবে, সেই নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট।
একটা দিন গেলো এই নিয়ে। তবে সামনে আসছে শুভদিন ....
তার ছাড়াই ব্রডব্যান্ড স্পিড পাওয়া যাবে - ভাবতেই ভালো লাগছে।

চাকুরি শিকারে আপাতত একটা "কমা" দিসি।

ফুলস্টপ দেই নাই অবশ্য, শীগগিরই ভালোমতোন কিছু শুরু না করলে না খেয়ে মরতে হবে এক বছর পর থেকে, সেইটা মাথায় আছে। সামার ইন্টার্ন করছিলাম যেইখানে, সেই গোল্ডম্যান স্যাক্স ছ্যাঁক দিছে, তবে সামান্যতম দুঃখ পাই নাই, কারণ ছ্যাঁকের তো কেবল শুরু। চলছে চলবে এইসব। তবে ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম গুলানের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, পৃথিবী এখন চীনা বা এশিয়ান রঙে রঞ্জিত হওয়ার জন্যে প্রস্তুত। মোটামুটি ক্ষতবিক্ষত মেরিল লিঞ্চ , মরগ্যান স্ট্যানলে, অন্যেরাও। ফার্মগুলানে ক্যাশ ইনজেকশন হইতেসে চীন বা সিঙ্গাপোর থেকে।

আমি আংভাঙ কম্প্যু সায়েন্সই ঠিকমতো বুঝি না আর এতো আমার পড়াশুনারও বাইরে, তাই এতোকিছু বুঝি না, তবে এই দুনিয়ায় নতুন দিনের শুরু মনে হয়।

কী ধরনের চাকুরির জন্যে ধান্দা মারা যায়, সেইটা নিয়েও একটা লাট্টুর উপরে আছি। সময় নাই, সিদ্ধান্ত একটা মনে হয় নিতেই হয় এবার।
শেষ পর্যন্ত কোনখানে যে যাইতে পারি! পেটের ভাত জুটবে তো? লাট্টু ...র উপরে সারাজীবন কাটলে তো সমস্যা।


২.
:: ডিসেম্বর ২১, ২৩:৩০ ::
সারাটা দিন খুব একটা কোন কাজ করিনাই। আউটপুট ছাড়া দিন বড়ই বিরক্তিকর।
এতোক্ষণ ল্যাবের খুব কাছাকাছি সিনিয়র-জুনিয়রদের সাথে ওকোনোমিইয়াকি ভক্ষণ আর আনুসঙ্গিক পানাহারে ব্যস্ত ছিলাম। সবাই নানান ব্যাপারে ইদানিং বেশ অস্বস্তি বোধ করে, তাই পানি পেটে পড়লেই বিষ বের হয়ে আসে সবার মুখ থেকে, আমিই একা পানিবিহীন গ্লাস নিয়ে শুনে যাই এবং তাল দেই। স্ট্রেস ঢালার জায়গার বড় অভাব বেচারিদের, তাই অপ্রিয় সবকথন চলে মদ্যসহযোগে।
এখন বাসায় ফিরবো। মাথা ব্যথা করছে ভীষণ। মাথায় যে কী হইসে?...

৩.
:: ডিসেম্বর ২৩, ০৩:৪০ ::
এতো রাতে জেগে থাকি কেনো? কে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলো গুগল টকে অনলাইন দেখে। উত্তর জানিনা। ইনসোমনিয়া? হ্যাঁ বা না কোনটাই বলবো না।

বাইরে বৃষ্টি সন্ধ্যা থেকে, একটা অলস দিন শেষে শুয়ে আছি। ঘুম থেকে উঠেছিলাম দুপুরের দিকে, অবশ্য ঘুমিয়েছিও ভোরের শেষে। সন্ধ্যা পর্যন্ত হাবিজাবি ব্রাউজিং - অনেকদিন পরে একটা P2P ফাইল শেয়ারিং টুল ইনস্টল করলাম। আই এম লিজেন্ড নামালাম, এখনো দেখা হয়নি যদিও। তারপর চাকুরির এন্ট্রিশীট জাতীয় কিছু প্রস্তুতিকাজ করার জন্যে ল্যাবে গিয়ে বসি নিজের কাস্টমাইজড ডেস্কে।

সন্ধ্যায় মটরের ডালের কারি আর নান - বাংলাদেশি দোকান থেকে প্যাকেট।
অনেকদিন রান্না করা হয় না - হিমু ভাইর রেসিপি দেখলে রান্না করতে ইচ্ছা করে, ট্যুনার কাবাব, ডিমের কারি এইসব গরিবী রান্না যদিও বড়ই অপছন্দ, অনেকদিন তো হলো এইসব রান্না।
প্রায় আধযুগ? জীবনের চারভাগের একভাগ! হুহ..
মস্তিষ্কে এইসব খাবারের উপর একটা বিতৃষ্ণার অনুভূতি স্থায়ী হয়ে গেছে।

৪.
::ডিসেম্বর ২৪, ০৩:৩০::
ডিসেম্বর ২৩ আরেকটা নিস্ফলা দিন। রোববার, ঘুম থেকে ওঠা স্বভাবতই দেরিতে, অনেক দেরি।
১২ টা পার করে। ঘরকন্নার কাজ, মেশিন থেকে কাপড় বের করে দেখি, রোদ পড়ে গেছে। কী আর করা, বস্তা বেঁধে বাসা থেকে কয়েকশ মিটার দূরে, কয়েন ড্রায়ারে দিয়ে আসি। আমার বাসায় ড্রায়ার নাই।
সন্ধ্যায় পার্থ আর রনি ভাইর সাথে ডিনার, অন্য সময়ের মতোই ঈশ্বরদর্শন বিষয়ক তর্ক দুইজনের, আমি অকাটমূর্খ শ্রোতা। চলুক, চলুক....তবে বেশি খাওয়া হয়ে গেছে ইন্ডিয়ান রেস্ট্যুরেন্টে। আর বিল খুব বেশি ছিলো।

শরীরটা ভালো নয়। আজ ঘুমাই।
ওহহো.,. ডিসেম্বর ২৩ সম্রাটের জন্মদিন। সম্রাট আকিহিতোর জন্মদিন, তবে রোববার বলে পাওনা সরকারি ছুটিটা কাল।


ফুরিয়ে যায় ২০০৭, পৃথিবীতে অচল মানুষ আমি আরো অচল হতে থাকি।
এইভাবে চলে আমার সবদিন। আটপৌরে জীবনের একাগল্পে এইসব দিন শেষে ভাবি, কালকে পৃথিবীতে আমাকে কী প্রয়োজন? আর প্রয়োজন যদি নাই থাকে, তবে এটাই কেনো শেষ দিন নয়?

-
ছবি কৃতজ্ঞতা , একই সাথে সচলায়তনে প্রকাশিত

সোমবার, ডিসেম্বর ১৭, ২০০৭

ঘুরপাক

অনেকক্ষণ ধরে এই পাতায় শুরুটা কীভাবে করবো, সেইটুকুতেই ঘুরপাক খাচ্ছি। অনেকদিন কিছুই লিখিনা, লেখার মতো মানসিক স্বস্তিটুকু পাই না বলে। একটা চক্রের মাঝে পড়ে আছি, নিকট-অতীত আর টানেলঅন্ধকার ভবিষ্যত বিরক্ত করছে সারাক্ষণ।

এইসব কিছুর শুরু কি জুলাইয়ের শুরুতে?
আলো হয়ে ছায়া হয়ে লুকোচুরি খেলে যাওয়া - গানটা শেষ শুনেছিলাম যখন। বিশ্বাস ভাঙার যে দৃশ্যে আমি প্রায়-পাগল হয়ে চুপচাপ অন্ধকার ঘরে বসে ছিলাম পুরো একটা দিন।
অথবা আগস্টের শুরুর ভাগের কোনও এক রাতে, তারবিহীন ফোনের ওপারে শ্রদ্ধাস্পদ শিমুল অথবা আলবাব ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন - সৌরভ, বাবা কেমন আছেন? আমি যে রাতে ঘুমোইনি। পাথরসম আমি ছাদের দিকে তাকিয়ে পার করেছি অনেকটা সময়।
না সেটা শুরু নয়। এইসব কিছু একেকটা বিন্দু, জীবনের সাদা পাতায় একেকটা কালো বৃত্ত।

কিংবা ডিসেম্বরের শুরুতে আমি যখন কোনও এক বৃষ্টিভেজা সকালে কেএল এয়ারপোর্টে কোনও একটা কফি-শপে ঢাকার কানেক্টিং ফ্লাইট ধরবার জন্যে বসে থাকি বোধ অথবা বুদ্ধিহীন হয়ে। একটা লাল টুকটুকে শার্টের উপরে কালো সোয়েটার আর বাদামী মাফলার জড়িয়ে - এলিমেন্টারি স্কুলে পড়া আদুরে বাচ্চাদের মতোন সাজে সেজে।

অথবা দুইদিনের বিমানভ্রমণ শেষে মফস্বলে পৌঁছে আমার বাবার ইল্যুশনমাখা গল্প বলে যাওয়া বিছানার পাশে পাথরের মতোন বসে থাকা, কিংবা আমার সদ্য বিয়ে করা বন্ধুটিকে তার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দেবার পর ফেরার পথে রিকশাওয়ালার না থেমে বলে যাওয়া গা শিউরে ওঠার মতো গল্প, দুদিন আগে তার এক কাছের বন্ধুকে কীভাবে ঘাতকেরা অস্ত্রাহত করে ফেলে রেখেছিলো মফস্বল শহরে নতুন তৈরি হওয়া হাইওয়ের ধারে।

সবশেষে, চারদিনের প্রায় অসহায় এক সময় শেষে দেশ ছাড়তে গিয়ে ফ্লাইট মিস করে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সেল্ফ-অফলোড এর জন্যে খালাম্মা ধরনের প্রশাসনিক কর্মকর্তার সামনে নতজানু হওয়া কিংবা ফেরার কানেকটিং ফ্লাইটের টিকেট ইনভ্যালিড হয়ে পড়া। এইসব ফর্মালিটিজ এর সামনে আমি দুর্বল হয়ে পড়ি ভীষণ ভীষণ। কিন্তু, সেইসব অস্থির অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি দিতে অজানা অচেনা মানুষেরা ভালবাসার ডালি নিয়ে হাজির হয় - যে ভালবাসা আমার প্রাপ্য নয়, তাতে আমি অস্বস্তি বোধ করি। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের এরিয়া ম্যানেজার ভদ্রলোকটি অথবা আমাকে ভীষণভাবে ঋণী করে যাওয়া এরিকসন বাংলাদেশে চাকুরি করা সেই মানুষটি, যিনি সবকিছু বাদ দিয়ে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত পুরো সময় ব্যয় করেছেন আমার পেছনেই।
এইসব ভালবাসায় আমার অস্বস্তি বোধ হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রিয় আত্মজনদের কষ্টের কাছে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়েছে, আমি পালিয়েছি নিজের কাছ থেকেই।
আত্মজনদের কাছে আমার পুনর্বার ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে।
গত সপ্তায় চাকুরির ইন্টারভ্যু দিতে গিয়ে মাঝপথেই কেমন যেন বুঝতে পারি,আমাকে বোধহয় আর ডাকবেনা। তারপরে সত্যি হয়ে ওঠে সে আশংকা।

এইসবের শেষ নেই। আমার মুক্তি নেই, আমি জানি। ইনসোমনিয়া রা ঘুরেফিরে আসে, দুই বছর আগে ইনসোমনিয়াকে বিদায় জানিয়েছি মনে করেছিলাম - সেটা মিথ্যে বোধ হতে থাকে।
বর্তমানের টানেল শেষে কী আছে - সেই ভাবনাটুকু থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারিনা। সবকিছুই কি আমার জীবনের অংশ? অথবা আমি কেবল দর্শক? কিংবা এভাবে ভাবলে বোধহয় ব্যাখ্যেয় হয় প্রশ্নটা- আমিই কি তাহলে আমার দর্শক?

আমার হেঁটে চলা পথে, আমি বোধ ও বুদ্ধিহীন পাথর-মানুষে রূপান্তরের কিউতে দাঁড়িয়ে থাকি অনেক সামনের দিকে, ডাকের অপেক্ষায়।
--
ছবি কৃতজ্ঞতা