সোমবার, ডিসেম্বর ৩১, ২০০৭

কীভাবে লিখবো আমার শেষ কবিতাটি?

প্রাণহীন হয়ে পড়া নগরের যাপিত জীবনে, নিজের প্রাণেও মৃত্যুর ছোঁয়া অনুভব করি কয়েকটা দিন। সারাবছর চাবি দেয়া যন্ত্রের মতো চলতে থাকা, এই দেশটায় নিউইয়ার এর সামনে-পেছনে প্রায় এক সপ্তাহ যেনো শ্মশানের ক্লান্তির ছায়া নেমে আসে। নগরের নয়, এমন মানুষেরা সব্বাই বছরে একবার হলেও বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে, বছরের বারো মাস চাবিটেপা পুতুলের মতো দৌড়ে চলা মানুষগুলো সামান্য হলেও ভুলে থাকা শেকড়ে ফিরে নিজেকে নতুন করে পাওয়ার চেষ্টা করে সম্ভবতঃ। আত্মজনের সাথে এক টেবিলে এক গ্লাস বিয়ার গিলে সামাজিকতা পালনের চেষ্টাও করে বোধহয় কেউ কেউ।

এই শহরে কখনো বন্ধ না হওয়া সুপার মার্কেটও দুটো বা একটা দিন বন্ধ হয়ে যায়; সারাবছর দাড়িয়েও টিকতে পারা যায় না ট্রেনে, বসার সীটগুলো খালি পড়ে থাকে; সাবওয়ের রেলস্টেশনগুলোকে দ্বিমাত্রিক জগত থেকে উঠে আসা কোন পট বলে ভ্রম হতে থাকে। প্রাণের অভাবে, জেঁকে বসা শীত নগরকে আরো কামড়ে ধরে।

এইসব কিছুর মাঝে বছরের এইসময়ে মৃত আমি আরো মৃততর হয়ে উঠতে থাকি। অন্যসময়ে ব্যস্ততার প্রলেপে চেপে রাখা যন্ত্রণাগুলো এইসময়ে আমাকে পতিত করে তোলে।

এই সময়টায় স্মৃতিকাতর আমাকে, শীতল সব স্মৃতিরা আরো কুরে কুরে খেয়ে ফেলার চেষ্টা করে। মনে পড়ে, স্কুলজীবনে ডিসেম্বর মানে, পরীক্ষাশেষে পড়াশুনার চাপ ছাড়াই ইচ্ছেমতো সময় কাটানো, বকুনি খাওয়ার ভয় ছাড়াই যতক্ষণ ইচ্ছা টিভি দেখা, এ সপ্তাহের নাটক অথবা মঙ্গলবারের সাপ্তাহিক কিংবা রোবোকপ অথবা সিন্দবাদ এর বাংলা ডাবড ভার্সনে বুঁদ হয়ে থাকা। অথবা বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা তিন গোয়েন্দা কিংবা কুয়াশা র ভল্যুমগুলো নিয়ে লেপের নীচে ঢুকে পড়া। কিন্তু, ইদানিংকালে নতুন করে বুঝি, এইসব আবছা আবছা ধোঁয়ামাখা স্মৃতিরা সময়ের সাথে সাথে মুছে যেতে থাকে।

পেছনে পড়ে থাকা আমার শৈশব আরো পেছনে চলে যায়, দূরে সরে যেতে থাকে। এই ২৫ এর অবস্থান থেকে দেখলে আমার পুরো দেশটাই আমার পেছনে পড়ে যায়, খুব ছোট দেখাতে থাকে সবকিছু। খুব যে অবাক হই, তা নয় - ১৭ তে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাকটিক্যালগুলো শেষ হয়ে গেলো যেদিন - তার দুদিন পরেই ঘর ছেড়ে ঢাকা যাওয়ার বাসে উঠে বসেছিলাম কোচিং করবার জন্যে। সেই শুরু। তারপরে নিজঘরে, নিজভূমে অতিথি বাকিটা সময়।
তারপরে অনেকদূর, অনেক সময়। ঘরকুনো অন্ধকার অনুভূতিশূন্য কেউ একজন আমি অন্ধকার নির্বাসনকেই বরণ করে নিই জীবনের পরিণতি হিসেবে।

অস্বীকার করতে চাই না, আমার আমিত্ব অন্ধকার ভরা। হৃদয়ে আমি মৃত্যুর ছায়া দেখি প্রতিনিয়তই। আমি পরিবারের ভালোবাসার লোভে বাঁচতে চাইনা, কারণ আমি স্বার্থপর। ধর্মকে অবলম্বন করে বাঁচি না আমি অথবা, ধর্মহীন ঈশ্বরহীনতায়ও নয়, কারণ আমি ভন্ডামির ধারক।

আহ, আপনি নিশ্চয়ইআশা-র কথা বলবেন? তার সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, মধুচন্দ্রিমার আগেই।

এই পাতাটি পড়তে থাকা আপনি "The Shawshank Redemption" নামের একটা চলচ্চিত্র নিশ্চয় দেখে থাকবেন, তরুণ ব্যাংকার অ্যান্ডি তার স্ত্রী ও স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমিক কে হত্যার মিথ্যা অভিযোগে কুখ্যাত শশ্যাঙ্ক জেলে নিক্ষিপ্ত হবার পরেও শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসে নিজের চেষ্টার জোরে, অনেক নাটকীয় ঘটনার পরে। আশা ছিলো একমাত্র বস্তু, যা তাকে জেলের কুঠুরিতে রিটা হেওয়ার্থ এর এক বিশাল পোস্টারের পেছনে ছোট হাতুড়ি দিয়ে গোপন সুড়ঙ্গ তৈরির মতো অসম্ভব এক কাজে প্রেরণার জোগান দিয়ে যায়। এক আশা আর জেলে তৈরি হওয়া বন্ধুত্বের ভালোবাসার জোরে শশ্যাঙ্কের জেল থেকে অ্যান্ডি সুয়্যারেজ পাইপ দিয়ে হাটুমুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে মুক্ত বৃষ্টির অবগাহনে। অস্বীকার করবার উপায় নেই, নায়ক অ্যান্ডির চরিত্রে টিম রবিন্স এর মুক্তবৃষ্টিস্নান এর সেই বিখ্যাত দৃশ্যটি আবেগপ্রবণ যে কাউকে আপ্লুত করে তুলবে অবশ্যই।

অনেকদিন পর পরশু আবার দেখলাম এই চলচ্চিত্রটি। উহুহ... একে ধর্মবিশ্বাস বা নৈতিকতার তথাকথিত জয়, অর্থাৎ হ্যাপি এন্ডিং এর প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিচ্ছু বলে বোধ হয়না।

তাহলে এই ভন্ড আমি-র মুক্তি কোথায়? মৃত্যুতে?
বহুদিন আমার মূর্খ ও ভন্ডামি ভরা ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক এই নিয়ে বিব্রত বোধ করেছে। ধর্মকে বিশ্বাস করলে মৃত্যুতে মুক্তির কোন প্রশ্নই আসেনা, মৃত্যু আরেক নির্বাসনের দরজা সেখানে। ধর্মের ভিত্তি ছাড়িয়ে নিলে, মৃত্যু অসার এক "নাই" এর জগত। মৃত্যু সেখানে সত্যিকারের প্রস্থানপথ, শ্যামসম।

কোনওভাবে জীবনকে টেনেটেনে যাপন করার চেষ্টার থেকে "প্রস্থানপথ", আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হবার যথেষ্ট কারণ যেখানে উপস্থিত, সেখানে খুব সত্যি করেই ভাবতে ইচ্ছে করে, কীভাবে লিখবো আমার শেষ কবিতাটি?
কীভাবে রচনা করবো আমার শেষ গান?