শনিবার, নভেম্বর ১৭, ২০০৭

ঝড়ে বিধ্বস্ত আমার মা, ভিনদেশির আহ্বান এবং নিরুপায় পরবাস


১.
ব্যস্ত এই জীবনে মনটা অস্থির হয়ে উঠলো, যখন বৃহস্পতিবার ল্যাবে তিনঘন্টার ম্যারাথন সেমিনার শেষে ডেস্কে এসে এই ছবিটা দেখলাম। কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলাম। টাইফুনের দেশে পরবাস, সারাবছরে কমপক্ষে ১০-১৫ বার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে টাইফুনের চোখের ছবি দেখানো এই আবহাওয়া-চিত্রগুলো খুব ভালোভাবেই বুঝি।

তাই রুদ্র সাইক্লোনের চোখের সম্ভাব্য পথের সামনে নিজের ওই ছোট্ট আয়তাকার দেশটুকু দেখে, ভয়ে শিউরে উঠেছি, একানব্বইর কথা ভেবে। এখনো চোখের সামনে ভাসে, পেপারে লাল কালিতে বড় বড় হরফে প্রথম পাতার অর্ধেক জুড়ে লেখা, কাঁদো, বাংলাদেশে, কাঁদো

তারপর সিডর এলো। সারারাত মনের অস্থিরতা কমেনি। ভূমিতে আসতে আসতে অনেক সাইক্লোনের গতি কমে যায়, পথ বদলায়। প্রার্থনা করছিলাম যেনো সেরকম কিছু ঘটে। আমরা এমনিতেই দুর্ভাগা, আরো কতো কষ্ট সহ্য করতে হবে আমাদেরকে?
সকালে গুগল নিউজ চেক করেই বুঝতে পারি, পুরো বাংলাদেশ আহত। রেখে গেছে ক্ষত পথে পথে। গতকাল আর আজ খবরের কাগজ আর বিভিন্ন তথ্যসূত্রে যে ছবিগুলো ছাপা হচ্ছে। তাতে সহজেই বুঝতেই পারা যায়, হতভাগ্য বাংলাদেশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে গেছে প্রলয়।

কী করতে পারি আমরা? দুর্যোগ আসবেই, ভৌগোলিক অবস্থানটাই এরকম, কিছু করবার নেই।
কিন্তু এই মুহুর্তে কী করবার আছে আমাদের?

২.
কিছু করতে চেয়েছেন শেরিল কার্সেনব্যম (Sheril Kirshenbaum, ক্ষমাপ্রার্থী, উচ্চারণটা কেমন হবে, আমার জানা নেই)। ডিউক য়্যুনিভার্সিটির এই মেরিন বায়োলজিস্ট তাঁর এই ভিডিও ব্লগিং পোস্টে মানবিক এই দুর্যোগে হাত বাড়ানোর একটা আহ্বান জানিয়েছেন তাঁর ব্লগের পাঠকদের প্রতি।
চোখদুটো আবার জলে ভরে গেলো, ভিডিওটা দেখে।



৩.
সুপরিচিত ব্লগার রেজওয়ান জার্মানি থেকে তাঁর এই পোস্টটিতে , যেখানে শেরিলের আহ্বানের কথাও উল্লেখ আছে, সেখানে তিনি দারুণ কিছু নির্দেশনা রেখেছেন হাত বাড়াতে আগ্রহী সহৃদয় সবার উদ্দেশ্যে। পাঠকদের সেই পোস্টটি পড়ার ও নিজেদের ব্লগে বা সাইটে কোনভাবে উল্লেখ করার অনুরোধ জানাই, যাতে ব্লগ সার্চ এর ফলাফল হিসেবে সেই নির্দেশনাগুলো উঠে আসে খুব সহজেই।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বলে, এই মুহূর্তে অর্থ বা ত্রাণ যথেষ্টই থাকবার কথা। কিন্তু জরুরি হচ্ছে সেগুলো পৌঁছুনো আর দেশের অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়বে, তা যতো কমানো যায়, সেই চেষ্টায় নিজের অংশগ্রহণ রাখা।
আর সবচেয়ে জরুরি, এই শীতের মধ্যে দুর্গতদের কাছাকাছি পৌঁছানো। সামনের শীতে মাথার উপরে ছাদ ছাড়া লাখ লাখ মানুষ থাকবেন - এটা মাথায় রাখা খুব খুব দরকার।

কীভাবে কি করা যায়, আমি জানি না।
নিরুপায় পরবাসে চোখ ভিজে যায় খুব সহজে, তাই লিখতে ইচ্ছে করলো এই লেখাটা। অর্থ-সমর্থন দিয়ে দুঃখ লাঘব হয়না, সেইটা খুব নিরুপায় একটা পথ। (আমি অর্থ-সাহায্য শব্দটি অপছন্দ করি ভীষণ )

তবু্ও বলি,
নিরুপায় অর্থ-সমর্থন দেবার জন্যে আমিও অন্যদের মতোন, রেডক্রস-রেডক্রিসেন্ট অথবা সেভ দ্য চিলড্রেন কে প্রথম পছন্দ হিসেবে মেনে নেবো। আমি জানি এখানে ভলান্টারি কাজ করে যাওয়া এনজিওতে গুলোতে কাজ করেছেন বা এখনো করেন, এরকম অনেকেই আছেন, তাঁদের কাছ থেকে কোন ধরনের তথ্যসংযুক্তি থাকলে কৃতার্থ হবো।

এইসবে কিছু হয় কি না আমি জানি না।
ফেসবুকে বা অর্কুটে গ্রুপ করে কিছু হয় না, এটা জানি - (কারো ভিন্নমত থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী)। কিন্তু মিডিয়া কাভারেজ বা প্রচারণা খুব জরুরি - এটা বিশ্বাস করি। তাই এই বিনীত নিবেদন।

লিংক-
বাংলাদেশ রেড-ক্রিসেন্ট সোসাইটি
Bangladesh Red Crescent Society
A/C No. 01-1336274-01
Standard Chartered Bank
Dhaka Bangladesh
SWIFT Code: SCBLBDDX
Red Cross Red Cresent
Bangladesh: Red Cross Red Crescent launches urgent appeal in wake of Cyclone Sidr

Save the Children
Thousands of Cyclone Survivors in Bangladesh Need Your Support

সচলায়তনে দেয়া ইশতিয়াক রউফ ভাইয়ের লিংক
Association for Bangladeshi Students at Virginia Tech
http://www.bang.org.vt.edu/makhan.html

শুক্রবার, নভেম্বর ০৯, ২০০৭

নভেম্বরের কোন এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় ...

নভেম্বরের এই শুরুর ভাগে সন্ধ্যেটা নেমে আসে ঝুপ করে। ঘড়ির কাঁটা চারটা পেরোলেই একটা ঠান্ডা বাতাস আমার বসার জায়গার পেছনের জানলা দিয়ে হুহু করে ভেসে আসে। একটু দূরে বসা জ্যৈষ্ঠ সহকর্মীটি জানলা বন্ধ করে দেবার জন্যে তোড়জোড় করতে থাকেন।

আমার আপত্তিতে জোর করেই জানলাটা খোলা রাখা হয়, হালকা ঠাণ্ডায় মায়ের বকুনি খাবার পরেও গরম কাপড় না পরা দুষ্টু উদোম গায়ের বাচ্চাদের মতোন। জানলার কাছে চেয়ারটা সরিয়ে উঁকি দিই বাইরে। অন্ধকার আর আলোর মাঝামাঝি একটা "প্রায়আধার" বাইরে থেকে কেমন যেন অপরাধবোধ নিয়ে চোখ পিটপিট করে আমার দিকে থাকে, যেনো সে লজ্জ্বা পায় বেশি তাত্তাড়ি এসে পড়ায়, আকাশটাকে কালো করে দেয়ায়। তারপর আমার মুচকি হাসিমুখ দেখে সেও সাহস পায়, পুরোপুরি মুড়ে ফেলে আকাশটাকে, ওপারের নির্জীব ইচো গাছগুলো ড্যাবড্যাব দাঁড়িয়েই পড়ে অন্ধকারেই, বাতাসে ভেসে আসে ওই গাছগুলোর উপরে বাসা বাঁধা টিয়া পাখিদের কিলিকিলি, চিলিচিলি।

এই স্কুলের আন্ডারগ্রেডারেরা, যারা বেশিরভাগই নার্ড এবং স্বভাবতই অন্তর্মূখি, অনেকেই ক্লাস শেষে ক্লান্ত দেহ নিয়ে টেনেটেনে বাড়ি ফেরার জন্যে ইচো গাছগুলোর নীচে ওই রাস্তাটা ধরে হেঁটে হেঁটে চলে। আমি জানলার পাশেই চুপচাপ বসে থাকি। একই রুমে বসা আরেক সহপাঠী কফি খাবো কি না জিজ্ঞেস করে একটা ডাক দেয়, আমি হ্যাঁ-হুঁ মাঝামাঝি কিছু একটা বলে আবার ডুবে যাই বাইরের অন্ধকারের সাথে কথোপকথনে।

একটা সময় ছিলো, যখন হিসেব করতুম - আচ্ছা এখন দেশে কয়টা বাজে, মা কী করছে - আজ কী রান্না হয়েছে - আজকে বাজার কে করেছে। এখন মস্তিষ্কের ওই জায়গাগুলো প্রায় মুছে বসে আছে। ওই কোষগুলো কবে মরে আবার নতুনেরা জায়গা নিয়েছে কে জানে। কিন্তু আজ কতো বছর পর কেনো যেনো ভাবতে ইচ্ছে করছে - দেশে কেবল দুপুর পার হলো, দেশে থাকলে হয়তো শুধু লাউয়ের তরকারি, কোন অপ্রিয় মাছের ঝোল আর তেল দেয়া আলুর ভর্তা দিয়ে হয়তোবা দুপুরের ভাত খেতাম একটা গোসল ছেড়ে এসে।
হয়তোবা, হয়তোবা নয়।

কিংবা ফেলে আসা বন্ধুগুলোর মতোন একটা চাকুরি খুঁজে হাপিত্যেশ হতাম অথবা সস্তায় কোন চাকুরিতে দিন পার করতাম আরো ভালো কোন সুযোগের আশায়। তার থেকে এই বর্তমানই ভালো লাগে। হোক না, মাঝরাতে বাড়ি ফিরি, কিংবা শুকনো রুটি বা ওনিগিরি চিবুতে চিবুতে অনেক কিছু ভুলে থেকে জোর করে দিন পার করি।

এইসব ভাবতে ভাবতে অন্ধকার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এইবার জানলা থেকে উঠি।
কী হতে কী হইনি, আর কোথায় থেকে কোথায় থাকিনি - এইসব দুঃখবিলাস মাঝেমাঝে নিজের কাছেই বিরক্তিকর ঠেকে। পানসে কফিতে চুমুক দেই। কফি ভাল্লাগেনা। এই ঘরটায় কফি আমার থেকে কেউ ভালো বানাতে পারেনা। সন্ধ্যেটা আরো বিষণ্ণ আর ঠাণ্ডা হতে থাকে।


নভেম্বর ০৯, সন্ধ্যে
ব্যাখ্যা - ইচো , ওনিগিরি
ছবি - পাঁচ বছর যেখানে কাটিয়েছি, আমার স্কুল

শুক্রবার, নভেম্বর ০২, ২০০৭

বৃত্তবন্দী

একেকটা সপ্তাহ দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়। সোম আসে, বিষ্যুদ আসে, আসে আরেকটা উইকএন্ড। ১২-১৪ ঘন্টা ল্যাবে-স্কুলে, মাঝেমাঝে ফাঁক বুঝে পাটর্টাইম, জব ইভেন্টে সুট-টাই পরে দাঁত কেলানো বা অন্যকিছু।

কাজের চাপ?
না, ভুল, আসলে কোন কাজই শেষ করতে পারিনা। সবই সিকিভাগ করে, অর্ধেক করে ফেলে রাখি। শেষ হয় না কোনকাজই।
নিজের পড়াশুনা যেখানে আছে, সেইখানেই পড়ে থাকে, রিসার্চ এর কাজ সামান্যতম হয়ে ওঠেনা, টনক নড়ে, যখন মাস্টারমশায় বলে বসেন, এই সপ্তায় সেমিনারে একটু গালি খেয়ে আসো - মানে প্রেজেন্টেশন দাও। চাকুরির অনলাইন অ্যাপ্লিকেশনগুলো করবো করবো করে করা হয়ে ওঠেনা। শীতের কাপড় কেনা দরকার, একটা ভালো জ্যাকেট, একটা মাফলার - অথবা মোজা - কেনা ফরজ হয়ে গেছে, অথচ সময় করে উঠতে পারিনা। রোজ সকালে সব মোজা র একটা করে কপি খুঁজে পাই, তার পেয়ার কে আর পাইনা।

খাবারের অভ্যাস খুব খারাপ হয়ে গেছে। রান্না করিনা অনেকদিন, দুই সপ্তাহ আগে ডাল রেঁধেছিলাম আর চিংড়ি ভর্তা, সেই শেষ। ফ্রিজে মুরগি আছে, কেনো যেনো কিমা করা মাংস কিনেছিলাম, সেটাও আছে। রান্নার সময় পাইনা। স্কুলে যাওয়ার পথে একটা ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান হয়েছে দুমাস হলো- বাঙালি মালিক, জাপানি বউ সাথে নিয়ে রেস্ট্যুরেন্ট চালায়। ভালোই রাঁধে, ল্যাবে যাওয়ার পথে প্যাকেট লাঞ্চ কিনে নেই সপ্তায় দুইতিনদিন। আর আছে, ম্যাকডোনাল্ডস এ নতুন মেন্যু, ম্যাকড়্যাপ, না হলে পুরনো বন্ধু ফিলে-ও-ফিশ তো আছেই।

শরীরটা ভালো নেই। বয়স বাড়ছে, সেটা বুঝতে পারি খুব ভালোমতোই ইদানিং। মাঝেমাঝে নিজেই নিজের কাছে ছুটি নেই, কোন একটা সন্ধ্যে বা কোন একটা সকাল - শুয়ে শুয়ে টিভি দেখি বা মুভ্যি। টিভিতে স্ক্রীম-৩ দেখছি এখন। এই ভোররাতে। একবার দেখেছি, আবার দেখছি। গত সপ্তায় য়্যুটিউব ঘেঁটে পারমিতার একদিন দেখেছি বসে বসে। একটা অনুভূতি জাতীয় রিভিউ লেখার চেষ্টা করলাম, শেষ করতে পারছি না। রবীন্দ্রসংগীতগুলো অপূর্ব লাগে ছবিটায়। বিপুল তরঙ্গ রে - গানটাকে যেমন করে তুলে আনা হয়েছে, সেটা অসাধারণ। মনটা অদ্ভূত অনুভূতিতে ভরে ওঠে।

দেখতে দেখতে বছরটা ফুরিয়ে এলো, নভেম্বর মাস পড়ে গেছে। আগামী দুটো মাস কীভাবে যাবে - জানিনা। বছরের শেষে একটা টিকেট বুকিং দেয়া আছে দেশে যাওয়ার। অসম্ভব মনে হচ্ছে যাওয়াটা এই মুহূর্তে। শিগগীরই টিকেট ক্যানসেল করে দেবো মনে হয়।
আমার একটা বদভ্যাস ছিলো, দেশে বন্ধুদের সবাইকে মাঝেমাঝে ফোন করে চমকে দিতাম। অনেকক্ষণ কথা বলতাম। এখন আর করতে ইচ্ছে করেনা। মরে যাচ্ছে অনেক ইচ্ছে।

দিনগুলো সব একরকম মনে হয় মাঝেমধ্যে। পৌনঃপুনিক বৃত্তে পড়ে আছি বোধ হয়। রাত শেষের সকালটা অন্যরকম হবে, অথবা উইকএন্ড শেষের সোমবারটা অন্যকোন অনুভূতি নিয়ে শুরু হবে- প্রত্যাশাই করি খালি। হয় না সেরকম।
একই বৃত্ত ঘুরে আসে। বৃত্তটা ভাঙতে পারিনা।


বিপুল তরঙ্গরে.. পারমিতার একদিন থেকে


ছবি - সিসিএল এর আওতায় ব্যবহার। কৃতজ্ঞতা - ক্রিস ডায়মন্ড