
আমার রাত কাটানো ছোট্ট ১২-১৩ স্কয়্যার মিটার এর ঘরে দুটো বাতি আছে, একটা রান্নার জায়গাটার দিকে আরেকটা একেবারে ঘরের ঠিক মাঝখানে।
অনেকদিন ঘরের মাঝের এই বাতিটা জ্বালাই না। রান্নার জায়গাটায় বাতিটা জ্বালিয়েই কাজ সারি। আসলে কারণ অবশ্য অন্য। আলো সহ্য করতে পারি না এখন আর।
পেঁচার মতো হয়ে গেছে স্বভাব। অনেক দেরিতে ঘুম থেকে উঠি। মাঝরাতে দৌড়ুতে বেরোই। ছেঁড়া নোংরা নদীটা হাতের ডানে রেখে উড়ে যাই থপ থপ শব্দ তুলে। সাইকেলে টহল দিতে বেরিয়ে পড়া পাড়াতো মামা পুলিশ বেচারির মাঝ রাতের ডিউটিতে দেখা হয়ে যায় অন্য সব দিনের মতো। চেহারা চেনা, কাজেই বিরক্ত করার কোন কারণ নেই। কিংবা শুঁড়িখানা থেকে টালমাটাল হয়ে ফিরতে থাকা কোন মানুষ, আমি দেখেও না দেখার ভান করি যেইগুলোকে। অহেতুক ঝামেলা এড়িয়ে দৌড়ুনোর গতি বাড়িয়ে তুলি।
চেনা পথ, এক ঘন্টা দৌড়ে আসি। ক্লান্ত হই - আবার ভালোও লাগে। মিশ্র অনুভূতি।
বাড়ি ফিরে ভাল লাগার অংশটুকু মাপতে বসি।
নাহ, ঘরের মাঝের ওই বড় গোল দুটো টিউব জ্বালানোর সাহস হয় না। অন্ধকারেই হাতরে রান্নার জায়গায় ওই বাতিটা খুঁজে বের করি। অথচ জানেন, বছর তিনেক আগে এই বাসাটায় আসার মাস দুয়েক পর আমি এই বাতিটার অস্তিত্ব আবিষ্কার করি। খেয়ালই করি নি অনেকদিন।
নিজের কাছে নিজেই কী যেন লুকোতে চাইছি আসলে। কী লুকোতে চাই - বুঝতে পারি না।
আজকাল গণকযন্ত্রের মুখোমুখি জীবনের ভাগ বেশ লম্বা হয়ে গেছে। যতক্ষণ জেগে থাকি, ৫০-৬০ ভাগ মনিটরের সামনে - খুব খারাপ অভ্যাস - জানি খুব ভালো করেই। বদলাতে চেষ্টা করি, পারি না। আগামী কয়েক মাস মনিটর দেখে পার করা দিন আর বাড়বে - দিন দিন কূপমণ্ডুক হতে থাকবো, গুছিয়ে কথা বলার ক্ষমতাটা কমে আসবে, টিপিক্যাল নার্ড এ পরিণত হওয়ার ধাপে আরো এগুতে থাকবো।
২.
নতুন সিমেস্টার শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ হলো, ক্রেডিট নিতে হবে আরো আট মতো। বেছে বেছে সন্ধ্যায় হবে এরকম তিনটে ক্লাস বাছাই করলাম। নাওকি ইনোসে, ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক, লেকচার - আধুনিক জাপানের ইতিহাস। স্কুলের টাকা বেশি হয়েছে - বুঝতে পারলাম - এরকম ফিগারকে ক্লাসে এনে হাজির করতে ট্যাকশো ভালোই যাচ্ছে নিশ্চয়ই। আহহারে, ভুল জায়গায় টাকা ঢালা হয়। আরেকটা ক্লাস নিলাম মনোরোগবিজ্ঞান ১০১ - সাইকিয়াট্রি। সেখানেও দেখি কোন এক বিখ্যাত মনোরোগ বিশারদ।
ইতিহাস, সমাজচিন্তা, রাজনীতি, ধর্ম, মনোবিজ্ঞান - এসব আমায় টানে কেনো যেনো। যন্ত্রপাতির পড়াশুনা ছেড়ে এগুলোর কোন একটাতে বদলিয়ে ফেলবো নিজের হাঁটাচলা - অনেকদিন ভেবেছি।
সে ভাবা পর্যন্তই।
এসব শুধু ভাবা পর্যন্তই। বাঙালি মধ্যবিত্তের বীজ শরীরে-মনে যার, সে এইসব ভাবনার বাস্তবায়ন করতে পারে না। সমাজচিন্তা করে পেটের ভাত জুটবেনা বলেই তো যন্ত্রবিজ্ঞান পড়ি, মানে পড়ার ভান করি। ডিগ্রির লোভে অভিনয় করে যাই প্রতিক্ষণ, প্রতি পল।
বাঙালি মধ্যবিত্ত ভুল পথে ভুল জীবন যাপন করতে থাকে, সে বাঁধা পড়ে পরিবারে, তার কাছে প্রত্যাশা করা যায় না কোন বিপ্লবের। তার ভাবনাগুলো মাথার রান্নাঘর থেকে বড়োজোর ডায়রির পাতায় আসে, খুব বেশি স্বপ্নবাজ হলে লিটল ম্যাগে যায়, দৈনিকের পাঠক ফোরামে আলোর মুখ দেখে। মধ্যবিত্ত বাঙালি আশি ভাগই ভুল সঙ্গী বা সঙ্গিনী বেছে নেয় - সমঝোতা করে কাটিয়ে দেয় বছর বিশ-ত্রিশেক, এইভাবেই টেঁসে যায় কোন একদিন।
৩.
এখন চব্বিশ-পঁচিশ, একটা সিম্যুলেশন করা গেলে ভাল হতো - বছর বিশেক পরে কোথায় কীভাবে থাকবো। বাঙালি মধ্যবিত্তের সিম্যুলেশন এনভায়রনমেন্ট তৈরি করে, সম্ভাব্য ইভেন্ট গুলো লিখে রান করে দেখা যেতে পারে। আচ্ছা, সিম্যুলেশনে কি আবেগজনিত আত্মহননের চেষ্টা অথবা পরিস্থিতিজনিত জীবন থেকে পলায়ন - এইসব ইভেন্টও রাখা উচিত হবে?
গত ছয় বছরে দুইবার আত্মহননের দুটো সূক্ষ্ম চেষ্টা চালিয়েছিলাম, বেশিদূর এগুতে পারিনি। আবেগের সাথে টানাটানিতে লজিক জিতে যাওয়ায় বেঁচে গেছি। সে গল্প শুনতে চাইলে বলতে পারবো না। তবে, কাগুজে ডায়রির পাতায় লেখা আছে । ছিঁড়ে বা পুড়ে ফেলবো বোধহয় কোনদিন।
সিম্যুলেশনটা ধোপে টিকবে না - মনে হচ্ছে।
এইসব জীবনে সিম্যুলেশন কাজ করে না।
এইসব জীবনে পেঁচারাই জিতে যায়।
এইসব জীবনে দেখিস একদিন আমরাও বলে শেষ করতে হয় নিজের বরাদ্দ সময়।
এইসব জীবনে বড় বাতিদের জ্বালিয়ে নিজের উপরে আলো ফেলার মতো সাহস হয় না কখনোই আর। তাই মেহের আলি র মতো ঘরের চারপাশে ঘুরতেই থাকি নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে আর চিৎকার দেই "তফাত যাও, তফাত যাও! সব ঝুঁট হ্যায়, সব ঝুঁট হ্যায়।"
----
ছবি নিজস্ব, সময়কাল- অক্টোবর ০৮, বাইরে ম্যাঁড়ম্যাঁড়ে বৃষ্টি, ঘরে আবদ্ধ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন