রবিবার, অক্টোবর ২১, ২০০৭

পৌনঃপুনিক মৃত্যু

আমার বর্তমান পৌনঃপুনিক। ঘুরেফিরে একই বৃত্ত। রাত শেষে আবার একই রকম আরেকটা দিন।
আমার অনুভূতিরা মৃত, তাদেরকে ঘিরে পোড়া মূর্তিরা খেলা করে। তাধিন তাধিন ধিন।
উদ্দাম নৃত্য। দুহাত তুলে, বৃত্ত রচনা করে।

বেসুরো আঁশটে গন্ধ আমার চারপাশে, পোড়া শব অথবা মনপ্রসূত অবাস্তবতা। পাথরের ঘষঘষে শব্দ।
হৃদয়কে আহত করা কিছু সুর। নস্টালজিক এবং মেলানকোলিক। খুঁজতে থাকি।
পাই না, পাই না সেই গানটা। বিপুল তরঙ্গ রে.. রবি বুড়োটার গান।

আমি হারিয়ে যাই। আমার ঈশ্বর খুঁজে ফিরি।
বৃত্তটায় গা এলিয়ে দেই ব্যাখ্যাহীন নির্ভরতায়।

শনিবার, অক্টোবর ২০, ২০০৭

এইসব দিন শেষে বৃষ্টি আসে

সকালে এখন ভালো ঠাণ্ডা পড়ে। দেশি কাঁথা আর একটা হালকা ব্লাংকেট গায়ে দিয়ে কাজ হয় না যদিও, তারপরো থোড়াই কেয়ার করি এইসব।

তিন ধাপের অ্যালার্মদেয়াল ব্যর্থ হয় না, সময়মতোনই ঘুম ভাঙে। প্রথমে বাজে সচল সেলফোন। তার পাঁচ মিনিট পর চিৎকার দেয় বিছানা থেকে একটু দূরে রাখা অচল সেলফোনের সেটটা, যেটা গত এপ্রিলে বদলানোর পর এখন অ্যালার্ম ছাড়া অন্য কোন কাজে আসে না। তারও দশ পনের মিনিট পরে বেজে ওঠে টেবিলঘড়ি, যেটাকে বন্ধ করতে বিছানা ছেড়ে কমপক্ষে চার পা হেঁটে যেতে হয়।

এতো কিছুর দরকার নেই আসলে, বেশিরভাগ দিনই প্রথম চিৎকারেই কাজ হয়, ঘরজুড়ে প্রফেসর শঙ্কু ধরনের এই চিৎকার ব্যবস্থা তৈরির পরও, মাঝে মাঝে অবশ্য অ্যালার্ম বন্ধ করে আরেকবার ঘুমুতে গিয়ে বিপদ ঘটেনি তা নয়। তারপরো এতো কিছু করা, কারণ - সকালে আন্ডারগ্রেডারদের এক্সপেরিমেন্টে কামলা খাটতে হয়। তাও একা। কোনভাবে মিস হয়ে গেলে লজ্জ্বার ব্যাপার। সেই সম্ভাব্য লজ্জ্বা থেকে বাঁচতে অগ্রীম ব্যবস্থা।

এক্সপেরিমেন্টের তিনঘন্টা পুরোপুরি ফাঁকি দেই, নিজের কাজ করে যাই, সচলায়তনে উঁকি দিয়ে সমন্বিত বাঘ ও অপরিণত ঘুড়া ক্যামনে কি কইরলো তাই পড়ে হাসতে থাকি, বিবিসিতে মিজ ভূট্টোর ভীতশংকিত চেহারা ও মৃতের সংখ্যার অবলীলায় তিন ঘর পার করে যাওয়া দেখে হতবাক হই। অবশ্য কিছুক্ষণ পরেই, খুব বড়োজোর এক মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড পরে ভুলেই বসে থাকি যে, অল্প কিছু মুহূর্ত আগে আহত হওয়ার মতো কোন খবর পড়েছি এবং একদল ভীতসন্ত্রস্ত আহত মুখ ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্তাক্ত মানুষের স্থিরচিত্র দেখেছি।

মানুষের শোকের আয়ু লগারিদমিক স্কেলে কমে যাচ্ছে বলেই মনে হয়। মানুষ নিদারুণ স্যাডিস্টিক হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আমিও ব্যতিক্রম নই তার। অন্যের পিছলে পড়ায় মনে মনে হাসি আর পারলে নিজেই কলার খোসা ছড়িয়ে রাখি, যাতে পিছলে যায় সব্বাই।

এইরকম ভাবতে ভাবতেই দিনটা শেষ হয়ে যায়।
আজকের মনোরোগবিজ্ঞান এর ক্লাসে ডিপ্রেশন টেস্টটা অদ্ভূত ছিলো, কোনরকম বিস্তারিত নির্দেশনা ছাড়াই আপনাকে একটা ঘড়ির ছবি আঁকতে বলা হবে, এরপর ঘড়ির কাঁটা ও ডায়ালের অবিন্যস্ততা অথবা ঘড়ির বৃত্তের আকৃতি দেখে আপনাকে বিশ্লেষণ করা হবে। আমার ইচ্ছে করছিলো, একটা ডিজিটাল ঘড়ির ছবি আঁকতে। হিহি, এই টেস্টে ডিজিটাল ঘড়ি আঁকলে তাকে পজিটিভ বলে ধরা হবে। মজাই লাগলো। মানুষের মস্তিষ্ক পুরোটাই পাজল।

সন্ধ্যায় বৃষ্টি নেমে আসে, সেই সাথে মনে পড়ে, জমে থাকা কাজের পাহাড় আরও উঁচু হচ্ছে। মেইল এর রিপ্লাই দিতে হবে কিছু, কিছু মেইল চালাচালি শুরু করতে হবে নিজের থেকেই, মেইলের প্রস্তুতি হিসেবে জার্নাল পেপার এর লিস্টি বানাতে হবে - চাকুরির অনলাইন এন্ট্রিতে লেখার জন্যে একগাদা মিথ্যে সাজাতে হবে সুন্দর করে। এইসব জায়গায় আমার লিখতে ইচ্ছে করে - আমি আসলে খুব দুঃখবাদী মানুষ, আমার ঘুড়ি ওড়াতে ভাল্লাগে, আমি একা একা শঙ্খনীল নদীর তীরে সূর্যাস্ত দেখতে বসে থাকি অথবা আমি অনেক সময়ই অসুস্থ থাকি এবং আমি আপাদমস্তক আধাপাগল মানুষ । তা না লিখে রচনা করতে হয় নিজেকে বিক্রির জন্যে নিজের বানানো প্রশংসাপত্র। এইসব ভেবে আহে..ম - বলা ছাড়া কোন পথ দেখিনা।

এইভাবে, এইসব দ্বন্দ্ব আর দ্বিধার শেকলে নিজের আত্মার বাঁধা পড়া আর অনেক কষ্টে ভুলে থাকা আত্মজনের অসহায়তা মাখানো স্মৃতি নিয়ে এইসব দিন চলতেই থাকে। কোন কোন দিনশেষে বৃষ্টি নামে ঝরঝর। মধ্যরাতে যখন আমার ১২ মিটার স্কয়্যার এর ঠিকানায় ফেরার জন্যে পথে নামি, তখন ভিজে যাই কিংবা ভিজি না। সেইসব দিনে এইসব লিখতে ইচ্ছে করে।
তাই লিখে রাখি। সব্বার বিরক্তির উদ্রেক করেই।


সময়কাল : অক্টোবর ১৯ শুক্রবার এর দিন পেরিয়ে রাত দুটো মতোন
ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা : উইন্ডোশপার , সিসিএল এর আওতায় ব্যবহৃত

রবিবার, অক্টোবর ১৪, ২০০৭

পাঁক

মা কে মনে পড়ে আমার, মা কে মনে পড়ে। আমি মাঝেমাঝে একা জলকবিতা বুনি। আমি একটা আধা-পাগল স্মৃতিকাতর মানুষ।

১.
ছোটবেলায় আমি পাঁকে পড়ে গিয়েছিলাম। পদ্মায়।
সেইবার, যেবার অনেক পানি হয়েছিল নদীটায়, টি-বাঁধ বন্ধ করে দিয়ে দিনে রাতে বিডিআর এর গাড়ি টহল দিতো বাঁধের উপরে। ঠিক সেইবার, বৃষ্টির মৌসুম শেষে পানি নেমে যাওয়ার পর বেড়াতে গিয়ে। যতই উঠতে চাই কাদা ছেড়ে, ততই টেনে ধরে কে যেনো। অনেক কষ্টে চিৎকার দিই, অভিকর্ষ বলকে পরাহত করতে পারি না, পায়ের সাথে স্যান্ডেলের স্পর্শ খুঁজে পাই না।

মায়ের নরম মুখটা মনে পড়ে, আবার জোরে চিৎকার দিই, আল্লাকে ডাকি, স্কুলের ধর্ম শিক্ষা বই থেকে শেখা যতো দোআ মনে পড়ে, সব বলতে থাকি। দূরে লুঙ্গি মালকোচা মারা মানুষের বিন্দু বড় হতে থাকে, একটা অচেনা মানুষ এসে আমায় তোলে। ধমক-টমকও দিয়েছিল বোধহয়।

তারপরও আমি নদীটাকে ভালবাসতাম। সেই বছরেই পানি বেড়ে যাওয়ায়, টি আকৃতি বাঁধের মাথার অংশটুকু সেই যে বন্ধ করে দিলো, আর খুললোইনা কখনো।

২.
আমার মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে প্রথম ট্রেন ভ্রমণের আবছা যে স্মৃতিটুকু সংরক্ষিত, তাকে আমি পুরনো ডায়রির পাতার মতো মাঝেমাঝে খুলে দেখি।
একটা অদ্ভূত দৃশ্য। একটা বাচ্চা, একজন নারী, একজন পুরুষ। আমি, আমার মা ও বাবা।
আমার মা প্রচণ্ড ব্যথায় কাতর। বাচ্চার দিকে খেয়াল দেওয়ার সময় নেই তার। বছর চারেকের বাচ্চা মানুষটা বিহ্বল ও অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মায়ের এই চেহারা সে কখনো দেখেনি।
(বাচ্চাটি বড় হয়ে শুনেছিল, তার মায়ের অসুখ করেছিল ভীষণ, আর তাদের ভ্রমণ ছিল উত্তরের অজপাড়াগাঁ থেকে রংপুর নামের শহরে, চিকিৎসার জন্যে।)

তার পরের বছর সেই বাচ্চাটি হঠাৎ একদিন দেখে, তাদের বাড়ির সব জিনিষপত্র ট্রাকে তোলা হচ্ছে। গ্রামের মেয়েরা মায়ের হাত ধরে কান্নাকাটি করছে, শান্ত-শীতল মা সবাইকে বলছেন - তিনি আবার আসবেন। বাবা বাড়ি দেখাশোনার জন্যে মামাদের সাথে কথাবার্তায় ব্যস্ত। তারপর ধূলো উড়িয়ে সেই ট্রাকটায় চড়ে সবাই মিলে হাজির হই একটা মফস্বল শহরে।

পঞ্চগড়, না শহর না গ্রাম - একবারে ধূলো ওড়ানো মফস্বলে চেহারা। করতোয়া নদী চিরে গেছে যার বুক। অনেকবড় একটা বাড়ি, অনেক গাছপালা, আম কিংবা অন্যকিছু। একদঙ্গল ভাই-বোন, সবাইকে আগলে রাখে সেই মমতাভরা মুখ। ছয়জনের মাঝে একেবারে ছয়নম্বর - সেইজন্যেই বুঝি আমাদের গল্পের বাচ্চাটা বড্ড বেশি মা-ন্যাওটা। তারপরও বাবা জোর করে শীতমাখানো সকালে করতোয়া নদীর উপরে ব্রীজে নিয়ে যেতেন, হিমালয় দেখবার জন্যে। রাশভারী বাবার আঙুল জড়িয়ে ছোট বাচ্চাটি হিমালয় দেখার চেষ্টা করে - আর, ভোরে বাইরে গেলে, ভাঁপা পিঠা কিংবা খেজুর রস নিয়ে বাড়ি ফেরা তো আছেই।
কিন্তু, সবচেয়ে বেশি ভাল লাগতো বাবার খসখসে আঙুল জড়িয়ে নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে।

নদীর জন্যে ভালবাসা সেই থেকে শুরু।
পঞ্চগড়ের মফস্বলে থাকা হয়নি বেশিদিন। তারপর রংপুরে অল্প সময়। সবশেষে এসে পড়ি পদ্মা পাশ দিয়ে নেচে নেচে চলে যাওয়া এই শহরটায়। রাজশাহীতে। ততদিনে হাফপ্যান্ট আর টি-শার্ট পরে বাইরে বেরিয়ে পড়ার বয়স হয়ে গেছে সেই পিচ্চি ছেলেটার।

৩.
পদ্মার ধার ধরে আমি হাঁটতাম।
বুড়োদের মতো। উদ্যমী সকাল অথবা বিষন্ন সন্ধ্যা কাটে আমার ভালবাসার নদীকে ঘিরে। আমার সব দুঃখ মুছে যায় চিকচিকে চাঁদের আলো পড়া জলধারার দিকে তাকিয়ে থাকলে।
তিন-চারঘন্টা টানা বৃষ্টি হলে শহর ডুবে যেতো, আমি থপথপ করে শব্দ তুলে স্কুলের পথে হাঁটা ধরতাম, কাদা মেখে ভিজে ফিরতাম। মা বকতো না। সে শহর বদলে যায়, অনেক ড্রেন তৈরি হয় শহর জুড়ে। আর কাদা হয়না, পানিতে ডোবেনা। শহরে আরো অনেক কিছুই পাল্টায়।
কেবল আমার নদী পাল্টায় না, আমার ভালবাসাও নয়।

আমার মা ও নয়। মায়েরা বদলায় না কেন যেনো।
আমার মা আমাকে কখ্খনো বকে না। আমার মায়ের নরম মুখছবি আমি কঠিন হতে দেখিনা। ১৮ বছর বয়েসে যখন আমি স্বার্থপরের মতো দেশকে ঠেলে বিমানবন্দরের কাঁচের দরজার মুখে মেটাল ডিটেক্টরের বাধাটা পেরিয়ে আসি, তখনও দেখি কাঁচের ওপারে নরম মুখ, জল ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা তাঁর মাঝে। নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হতে থাকে।

৪.
এই গ্রীস্মের কোন এক সন্ধ্যার কথা। আমি ক্লান্ত শরীর ও মন নিয়ে আমার বিদ্যাপীঠ থেকে বাসায় ফিরি ও ফোন তুলে নিয়ে প্রায় চারদিন পর নিজের আত্মজনের খোঁজ নেবার আপাত-ব্যর্থ চেষ্টা করি। নরম মুখচ্ছবির সেই কণ্ঠ শুনতে পাই ওপারে। আমার ক্লান্তি কেটে যায় অনেকটা, কিন্তু মনটা খচখচ করতে থাকে।

১৯ বছর আগের ট্রেনে সেই বাচ্চা মানুষের স্মৃতিকোষগুলোতে যে মুখছবি রাখা, ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসা কণ্ঠে শব্দের যে ছবি তার সাথে মেলেনা।
অনেকক্ষণ পরে বুঝতে পারি, আমার জনক ভালো নেই। আর এবারের আঘাতটা মস্তিষ্কে। শরীরে জেঁকে বসা হৃদরোগ আর ব্লাড সুগারের বিভ্রাট জনিত সমস্যাগুলো তো আগে থেকে আছেই । অপরাধবোধের অনুভূতি আমাকে ঘিরে ধরে। যে সময়ে আমার যেখানে থাকা উচিত, আমি সেই সময়ে সেখানে থাকতে পারিনা।

শান্ত জলধারার নদীর কান্না আমি শুনি। শুধু শুনেই যাই।
আমি এই পরবাসে সুখী মানুষ ও সুখের অভিনয় করে যাওয়া মানুষদের দেখে মুগ্ধ হই, নিজেও সুখের রেসিপি খুঁজি।
তাই আমার সময় হয়না নদীর ডাকে সাড়া দেবার, জননীর পাশে বসে থাকার। এই পাথুরে নগরে আমি খুব স্বাভাবিক নাগরিকের মতো একেকটা দিন পার করতে থাকি।
আমি অনুভব করি, সেই যে পাঁক - ছেলেবেলায় আমায় মুক্তি দিয়েছিল, ধীরেধীরে আমি নিজেই সে পাঁকে তলিয়ে গেছি, স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করেছি সেই পরিণতি।
শুকিয়ে গেছে আমার, ছেলেবেলার ভালবাসার নদী।

২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০০৭



এই লেখাটি লেখা হয়েছিলো অনলাইন রাইটার্স কমিউনিটি সচলায়তন এর ই-বুক ফেলে আসা ছেলেবেলা র জন্যে। অন্যদের দারুণ সব স্মৃতিচারণের মাঝে আমার এই না-ছেলেবেলা না-এইবেলা আঁকিবুঁকির চেষ্টা ধরনের লেখাটিও সমন্বয়ক আরিফ জেবতিক কেন যেন বইটিতে স্থান দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রতি।
ফেলে আসা ছেলেবেলা ই-বই টি পিডিএফ আকারে পাবেন এখানে

ছবি কৃতজ্ঞতা উপরের ছবি-ফ্লিকার, নিচের ছবি নিজস্ব

শুক্রবার, অক্টোবর ০৫, ২০০৭

"তফাত যাও, তফাত যাও! সব ঝুঁট হ্যায়, সব ঝুঁট হ্যায়।"

১.
আমার রাত কাটানো ছোট্ট ১২-১৩ স্কয়্যার মিটার এর ঘরে দুটো বাতি আছে, একটা রান্নার জায়গাটার দিকে আরেকটা একেবারে ঘরের ঠিক মাঝখানে।
অনেকদিন ঘরের মাঝের এই বাতিটা জ্বালাই না। রান্নার জায়গাটায় বাতিটা জ্বালিয়েই কাজ সারি। আসলে কারণ অবশ্য অন্য। আলো সহ্য করতে পারি না এখন আর।

পেঁচার মতো হয়ে গেছে স্বভাব। অনেক দেরিতে ঘুম থেকে উঠি। মাঝরাতে দৌড়ুতে বেরোই। ছেঁড়া নোংরা নদীটা হাতের ডানে রেখে উড়ে যাই থপ থপ শব্দ তুলে। সাইকেলে টহল দিতে বেরিয়ে পড়া পাড়াতো মামা পুলিশ বেচারির মাঝ রাতের ডিউটিতে দেখা হয়ে যায় অন্য সব দিনের মতো। চেহারা চেনা, কাজেই বিরক্ত করার কোন কারণ নেই। কিংবা শুঁড়িখানা থেকে টালমাটাল হয়ে ফিরতে থাকা কোন মানুষ, আমি দেখেও না দেখার ভান করি যেইগুলোকে। অহেতুক ঝামেলা এড়িয়ে দৌড়ুনোর গতি বাড়িয়ে তুলি।

চেনা পথ, এক ঘন্টা দৌড়ে আসি। ক্লান্ত হই - আবার ভালোও লাগে। মিশ্র অনুভূতি।
বাড়ি ফিরে ভাল লাগার অংশটুকু মাপতে বসি।
নাহ, ঘরের মাঝের ওই বড় গোল দুটো টিউব জ্বালানোর সাহস হয় না। অন্ধকারেই হাতরে রান্নার জায়গায় ওই বাতিটা খুঁজে বের করি। অথচ জানেন, বছর তিনেক আগে এই বাসাটায় আসার মাস দুয়েক পর আমি এই বাতিটার অস্তিত্ব আবিষ্কার করি। খেয়ালই করি নি অনেকদিন।

নিজের কাছে নিজেই কী যেন লুকোতে চাইছি আসলে। কী লুকোতে চাই - বুঝতে পারি না।
আজকাল গণকযন্ত্রের মুখোমুখি জীবনের ভাগ বেশ লম্বা হয়ে গেছে। যতক্ষণ জেগে থাকি, ৫০-৬০ ভাগ মনিটরের সামনে - খুব খারাপ অভ্যাস - জানি খুব ভালো করেই। বদলাতে চেষ্টা করি, পারি না। আগামী কয়েক মাস মনিটর দেখে পার করা দিন আর বাড়বে - দিন দিন কূপমণ্ডুক হতে থাকবো, গুছিয়ে কথা বলার ক্ষমতাটা কমে আসবে, টিপিক্যাল নার্ড এ পরিণত হওয়ার ধাপে আরো এগুতে থাকবো।

২.
নতুন সিমেস্টার শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ হলো, ক্রেডিট নিতে হবে আরো আট মতো। বেছে বেছে সন্ধ্যায় হবে এরকম তিনটে ক্লাস বাছাই করলাম। নাওকি ইনোসে, ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক, লেকচার - আধুনিক জাপানের ইতিহাস। স্কুলের টাকা বেশি হয়েছে - বুঝতে পারলাম - এরকম ফিগারকে ক্লাসে এনে হাজির করতে ট্যাকশো ভালোই যাচ্ছে নিশ্চয়ই। আহহারে, ভুল জায়গায় টাকা ঢালা হয়। আরেকটা ক্লাস নিলাম মনোরোগবিজ্ঞান ১০১ - সাইকিয়াট্রি। সেখানেও দেখি কোন এক বিখ্যাত মনোরোগ বিশারদ।
ইতিহাস, সমাজচিন্তা, রাজনীতি, ধর্ম, মনোবিজ্ঞান - এসব আমায় টানে কেনো যেনো। যন্ত্রপাতির পড়াশুনা ছেড়ে এগুলোর কোন একটাতে বদলিয়ে ফেলবো নিজের হাঁটাচলা - অনেকদিন ভেবেছি।
সে ভাবা পর্যন্তই।

এসব শুধু ভাবা পর্যন্তই। বাঙালি মধ্যবিত্তের বীজ শরীরে-মনে যার, সে এইসব ভাবনার বাস্তবায়ন করতে পারে না। সমাজচিন্তা করে পেটের ভাত জুটবেনা বলেই তো যন্ত্রবিজ্ঞান পড়ি, মানে পড়ার ভান করি। ডিগ্রির লোভে অভিনয় করে যাই প্রতিক্ষণ, প্রতি পল।
বাঙালি মধ্যবিত্ত ভুল পথে ভুল জীবন যাপন করতে থাকে, সে বাঁধা পড়ে পরিবারে, তার কাছে প্রত্যাশা করা যায় না কোন বিপ্লবের। তার ভাবনাগুলো মাথার রান্নাঘর থেকে বড়োজোর ডায়রির পাতায় আসে, খুব বেশি স্বপ্নবাজ হলে লিটল ম্যাগে যায়, দৈনিকের পাঠক ফোরামে আলোর মুখ দেখে। মধ্যবিত্ত বাঙালি আশি ভাগই ভুল সঙ্গী বা সঙ্গিনী বেছে নেয় - সমঝোতা করে কাটিয়ে দেয় বছর বিশ-ত্রিশেক, এইভাবেই টেঁসে যায় কোন একদিন।

৩.
এখন চব্বিশ-পঁচিশ, একটা সিম্যুলেশন করা গেলে ভাল হতো - বছর বিশেক পরে কোথায় কীভাবে থাকবো। বাঙালি মধ্যবিত্তের সিম্যুলেশন এনভায়রনমেন্ট তৈরি করে, সম্ভাব্য ইভেন্ট গুলো লিখে রান করে দেখা যেতে পারে। আচ্ছা, সিম্যুলেশনে কি আবেগজনিত আত্মহননের চেষ্টা অথবা পরিস্থিতিজনিত জীবন থেকে পলায়ন - এইসব ইভেন্টও রাখা উচিত হবে?

গত ছয় বছরে দুইবার আত্মহননের দুটো সূক্ষ্ম চেষ্টা চালিয়েছিলাম, বেশিদূর এগুতে পারিনি। আবেগের সাথে টানাটানিতে লজিক জিতে যাওয়ায় বেঁচে গেছি। সে গল্প শুনতে চাইলে বলতে পারবো না। তবে, কাগুজে ডায়রির পাতায় লেখা আছে । ছিঁড়ে বা পুড়ে ফেলবো বোধহয় কোনদিন।
সিম্যুলেশনটা ধোপে টিকবে না - মনে হচ্ছে।
এইসব জীবনে সিম্যুলেশন কাজ করে না।

এইসব জীবনে পেঁচারাই জিতে যায়।
এইসব জীবনে দেখিস একদিন আমরাও বলে শেষ করতে হয় নিজের বরাদ্দ সময়।
এইসব জীবনে বড় বাতিদের জ্বালিয়ে নিজের উপরে আলো ফেলার মতো সাহস হয় না কখনোই আর। তাই মেহের আলি র মতো ঘরের চারপাশে ঘুরতেই থাকি নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে আর চিৎকার দেই "তফাত যাও, তফাত যাও! সব ঝুঁট হ্যায়, সব ঝুঁট হ্যায়।"
----

ছবি নিজস্ব, সময়কাল- অক্টোবর ০৮, বাইরে ম্যাঁড়ম্যাঁড়ে বৃষ্টি, ঘরে আবদ্ধ