রবিবার, জুন ১৭, ২০০৭

ফিরতেই তো চাই, বাবা!

সরীসৃপ আমি অপছন্দ করি। ছোটবেলার একটা স্মৃতি এখনো আমাকে ভয়ানুভূতিতে আন্দোলিত করে ।

আমি আমাদের লিচু গাছটার নীচে একটা জলচৌকিতে শুয়ে আছি, পাশে তিনি।
একটা সাপ উপর থেকে আমাদের জলচৌকিতে প্রায় আমার গায়ে এসে পড়ে, কিছুক্ষণ পর তাঁর কোলে নিজেকে আবিষ্কার করি।
সাপটাকে পরে মারা হয়।

তিন-চার বছর বয়সের স্মৃতি কারও মনে থাকে?
কেন যেন আমার মনে আছে।
সেবার আমার ঘাঁড় শক্ত হয়ে যাওয়ার অসুখ হয়েছিল। তিন অথবা চার তখন। বাড়িতে মামা সম্পর্কীয় একজন বড় ভাই-বোনদের পড়াতেন, তাঁর কাছে আমিও বসে যেতাম পড়তে।
অক্ষরজ্ঞান রপ্ত হয়নি তখনো।

বাচ্চার মেনিনজাইটিস - ডাক্তার বলে। তিনি চাকুরিতে লম্বা ছুটি নিয়ে আমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকেন লিচু গাছটার নীচে।
একগাদা ইনজেকশন, সন্ধ্যাবেলায় দিতে আসতো এক ডাক্তার।

সন্ধ্যাবেলা, অন্ধকারটা যখন একটু জড়িয়ে আসে, লিচু গাছটার ওপাশে খড়ের গাদাগুলোকে আবছা অন্ধকারে ভৌতিক কোন মূর্তির মতো মনে হয়, কুকুরে কামড়ে দেয়া আম গাছটার ওপারের ধুলো ওড়ানো রাস্তাটা ধরে হাটে যাওয়া মানুষগুলো ফিরতে শুরু করে যখন - সেই সময়ে।
বাবার কোলে বসে আমি, ধমনী খুঁজে না পেয়ে ডাক্তার ব্যাটা নাকানি-চুবানি খায়।

লিচু গাছটা এখনো আছে, চাঁপা গাছটার পাশে, গোরস্থানের ঠিক সামনে।
সেই গাছটা দেখলে আমি এখনো ভয় পাই। সরীসৃপের স্মৃতি মনে পড়ে আমার।

মেনিনজাইটিস সেরে যাওয়ার এক বছর পরে আমরা গ্রাম ছাড়ি, শহরে আসি জনকের চাকুরি সূত্রে।
শহর বললেও সে এক মফস্বল - করতোয়া নদী আর একটা ছোট ব্রীজ, চিরে ফেলেছে মফস্বল শহরটাকে - জনকের আঙুল ধরে ছোট সৌরভ হাঁটে, শীতে জনকের কোলে চড়ে হিমালয় দেখার চেষ্টা করে।
দুপুরে বাড়িতে খেতে আসা গুরুগম্ভীর বাবার পাশে গুটিসুটি মেরে অপ্রিয় দুপুরি-ঘুম দিয়ে দেয় এক প্রস্থ। বাবাটা যেন কেমন, বাইরে কতো মজা, দুপুরে না ঘুমুলেই হয়না?

-----------------------

তারপরের গল্প যেরকম হয়, সেরকমই।
আমি, সৌরভ বড় হয়ে যাই অন্য সবার মতো। জীবনের প্রয়োজনে বাড়ি ছাড়ি, মফস্বল ছাড়ি, শেষ পর্যন্ত দেশও ছেড়ে দিতে হয়।
বছরে এক-আধবার যাই বাড়িতে।

প্রতিবছরই বাবাকে দেখি - অনুভব করি - বুড়ো হয়ে গেছেন আগের বারের থেকে আরেকটু ।
গুরুগম্ভীর বাবা, যাকে আমার বন্ধুরাও ভীষণ ভয় পেতো, আমরা ভাই-বোনেরা পড়াশুনো না করে টিভি দেখতাম বলে যিনি এক আছড়ে ভেঙে ফেলেছিলেন যন্ত্রবাক্সটা - নিজের জন্যে অনুভব করি তাঁর আকুলতা ।
ফোনে শুনি - কবে আসবি?
রেগেমেগে উল্টোপাল্টা বলি - সামারে ইন্টার্ন করবো, হ্যান করবো - সময় নাই আসার
এপারে বৃষ্টি ঢাকি, "বাবা, আসতে তো চাই সবসময় - কতো শেকল" ।

বাবা, জানো, আমি এখনো সরীসৃপের স্বপ্ন দেখি, ঘেমে উঠে ঘর ঠান্ডা করতে সুইচ টিপি।
পঞ্চগড়ে আমরা যখন থাকতাম, তখন প্রচন্ড ভূমিকম্পে কোন এক ভোরে তুমি পাঁচ-ছয়বছরের একটা ভারী বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বাড়ির বাইরে ছুটে গিয়েছিলে, মনে পড়ে, বাবা?
আমার মনে পড়ে।
এখন যে মাঝেমধ্যেই ভূমিকম্প হয় মাঝরাতে।

বহুদিন ইচ্ছে করে, জিজ্ঞেস করি - পিতঃ, এই অক্ষম সন্তানকে নিয়ে কোন স্বপ্ন করেছিলে কি রচন?
করা হয়না, করতে পারিনা।
বাবার সাথে দূরত্ব অনেক এখন।
কয়েক হাজার কিলোমিটার অথবা কয়েকটা দেয়াল।

দূরত্ব অথবা সে দেয়াল অতিক্রমের সাধ্য আমার নেই।

জুন ১৭, ২০০৭
-----
ছবিটা প্রাসঙ্গিক, সেই লিচু গাছটা ছবিতেই আছে

২টি মন্তব্য:

শামীম বলেছেন...

দারুন!! হৃদয় ছুঁয়ে গেল লেখাটা।

সৌরভ বলেছেন...

কৃতজ্ঞতা, শামীম ভাই।
ভাল্লাগলো এতদূর এসে ব্লগ পড়ছেন দেখে।

সামনে দেখা হবে অন্য কোথাও।