বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৬, ২০০৭

দহন-দাসত্ব এবং জলকবিতা বিষয়ক

দাসত্ব পর্ব
------------------

কাল রাতে এক ফোঁটা ঘুমুতে পারিনি ।

সন্ধ্যা থেকেই সেই পুরনো গল্প ।
আব্বার চেচাঁমেচি, মায়ের হাড়িঁ-পাতিল আছাড় দেয়ার শব্দ আর ...
আরও অনেক কিছু ।
মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে - একটা চমকে দেয়া চিৎকার দিয়ে এ বাড়ির থেমে যাওয়া বাতাসটাকে উড়িয়ে দিই । কিংবা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিই দু-একটা ঘর ।
অথবা বেরিয়ে যাই সবকিছু ছেড়ে ।
বুবু টা কাঁদে, কাঁদি আমিও - ভিতরটা পুড়ে যায় জলের আগুনে ।
আমি তাও সারাদিন বাইরে বাইরে কাটাই, এখানে-ওখানে, টিউশনিটা আছে - মোটামুটি দিন যায় ।

পালিয়ে থাকি - বলতে গেলে ।
রাত করে ফিরি মাঝেমাঝে - শুনতে হয় - মাথা কিনে ফেলেছো দেখি
আমার জন্মদাতা - কেন যেনো কেবল আমার সাথেই প্রায় বই এর ভাষায় কথা বলেন । ভাষা যত ভদ্র - বুঝতে হয় - মেজাজ ততো খারাপ ।

বুবু টা প্রায়দিন বাড়িতেই থাকে - ভার্সিটি যায় মাঝেমধ্যে - সেই যা ।
বয়সের ব্যবধানটা বেশ - আধা যুগের মতো - ওর সবকিছু শুনি - কেমন নির্দ্বিধায় সব গল্প বলে যায় - কেউ দেখলে মনে করবে - একই ক্লাসে পড়া দুটো বন্ধু ।
রক্তের সম্পর্কটা ওর সাথে কেমন যেন খাপছাড়া যদিও।
আমার আর ওর জনক এক নয় ।

আমার ভয় করে - আমি গত মাসে ওকে না বলে একটা কাজ করে ফেলেছি । আমি পালানোর পরিকল্পনা করে ফেলেছি - এই নরক ছেড়ে ।
ও তাও কাঁদে - কেঁদে হালকা হয় । আমি কাঁদতেও পারি না - পুড়তে থাকি ।



অর্পিতা পর্ব
-------------------
মার্চ ৩১, ১৯৯০, লেখাটার ডানদিকে তারিখটা ছোট করে দেয়া ।
ডাইরি টা এখানেই শেষ । তারপরের পাতাগুলো খালি ।

অর্পিতার ডাকে ঘোর টা কাটলো - কী হয়েছে? চোখেমুখে উদ্বেগ স্পষ্ট ওর ...
সম্বিত ফিরে পাই - ১৭ বছর আগের ছবিগুলো এতো স্পষ্ট কেনো? বুবুর মুখ, অসহায় উনিশ এর আমি, ঠান্ডা স্যাঁতস্যাঁতে মফস্বল কিংবা ভাঁপা পিঠার ওম ধরানো সকাল অথবা অন্য একটা মুখচ্ছবি মায়াভরা ।

সব ছবি ছাপিয়ে বর্তমানের অর্পিতা র উদ্বেগ আমাকে আকর্ষণ করে - চোখের জল মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করি।

কাল একটা ডাকে এসে পৌঁছেছে পার্সেল টা , শুধু একটা ডায়রি ..আর কিছু না ।
প্রেরকের ঘরে মেয়েলি হাতে বড় বড় অক্ষরে আমার নাম - যেন আমাকেই উপহাস করতে থাকে ।
পার্সেলের উল্টো পিঠে এক মাস আগের সীল - সময়চিহ্ণ বা স্থান - আমি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই ।
ঠিকানাটা অবশ্য দু-বছর আগে ছেড়ে আসা কাজের জায়গার ।
কিন্তু ১৭ বছর - মানে প্রায় দেড় যুগ ।

এতক্ষণে অর্পিতা - মানে, যাকে সবসময় অরু বলে ডাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি - কিংবা গরু-সরু একটা কিছু মিলিয়ে ঠাট্টাও করতাম একটা সময় - বিরক্ত হয়ে প্রায় ধূসর হয়ে যাওয়া লেখাগুলোর প্রতি কৌতুহল অথবা ঈর্ষা বোধ করে সম্ভবতঃ ।
তাই ছিনিয়ে নেয় জিনিষটা ।
আমি কোনওভাবে কিচেনের দিকে পা বাড়াই - কী একটা স্যুপ বসিয়েছে অরু - গত ক্রিসমাসে কোন পার্টিতে কে বানিয়েছিল - তার কাছে থেকে রেসিপি যোগাড় করে এনেছে - বদখত একটা গন্ধ বেরুচ্ছে ।

সিগ্রেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে পা বাড়াই - একুশ তলার উপর থেকে মেঘ ছুঁয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয় - মাঝে মধ্যে নিচের দিকে তাকালে একটা অদ্ভুত মাদকতা অনুভব করি সবসময় - লাফ দিতে ইচ্ছে করে ।

অরু কে বলেছিলাম একদিন কথাটা ।
পরের দুই-তিনদিন ব্যালকনি তেই যেতে দেয়নি ও । অফিসে গিয়েও ঘন্টায় ঘন্টায় ওর ফোন ধরে নিজের ঠিক থাকার প্রমাণ দিতে হয়েছে ।


জলকবিতা পর্ব
------------------------------------
বৃষ্টির ছটা এসে গায়ে লাগে ।

১৭ বছর আগের তরুণ এরকম একটা একুশ তলার খোলা বারান্দায় থাকলে কী করতো জানিনা ।
লাফিয়ে পড়তো ? নাহ বোধহয় ।

তবে তরুণটি বোধহয় রোমান্টিক ছিল, ছিল স্বপ্নবাজও - প্রথম টিউশনির টাকা দিয়ে জীবনানন্দের কবিতাসমগ্র কেনা , বুবুর জন্যে দুই ডজন কাঁচের চুড়ি নিয়ে এসে চমকে দেয়া অথবা নিভু-নিভু সমাজতন্ত্রের যুগে দিনবদলের স্বপ্ন দেখার "বলশেভিক পাঠচক্র" নামের প্রায় নিভে যাওয়া আড্ডার হাল ধরা - সবকিছু মিলিয়ে কী ছিলো না সেই তারুণ্যে?

ছিলো মায়াভরা মুখচ্ছবির সুচরিতা অথবা সূচি - পার্সেলটায় প্রেরকের ঘরে যার নাম-ঠিকানা লেখা - বুবু যার নাম করে ক্ষেপাতো সবসময় - কিংবা যার কথা অর্পিতাকেও কখনো বলা হয়নি ।

সতের বছর ?
সূচি র মুখটা মনে করতে পারি না । নিশ্চয়ই ঘর করছে কারও ..
সেটাই প্রত্যাশা করবো ভুলে থাকা ঈশ্বরের কাছে ।
কিংবা বুবু?

বৃষ্টি জোরে আসে ।
সতেরো বছর - কৃষ্ণগহবরে হারিয়ে যাওয়া কাল - দহন-দাসত্বের শেকল পরে পার করা সময় ।
পেছনে শব্দ ।
আমি মুখ লুকোই - অরু চলে যায় ।
সুযোগ করে দেয় - আমাকে ভেসে যাওয়ার ।
আমি একা জলকবিতা বুনতে থাকি ।


এপ্রিল ২৫, ২০০৭; নির্বাসন থেকে লেখা ।
উৎসর্গ : ধূসর গোধূলি

এ লেখাটা পরীক্ষামূলক ,
হাজারদুয়ারী র জন্যে ; ধুসর গোধূলি র পাল্লায় পড়ে লেখা
তাকেই উৎসর্গ ।
ধুসর গোধূলি - গদ্য হয়েছে কি না জানিনা , কিন্তু আপনি না বললে এই লেখাটা গুগল-ডক এর ড্রাফট থেকে কখনোই মুক্তি পেতো না।
কৃতজ্ঞতা ।

মঙ্গলবার, এপ্রিল ১০, ২০০৭

অন্য কোন আমি র সন্ধানে

অনেকদিন কোন পোস্ট করি না ।
বিশেষ কোন কারণ নাই - ব্যস্ততা, শরীরযন্ত্রের বিট্রে করে বসা আর কী নিয়ে লেখা যায় - সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পাওয়া ।
আরেকটা এপ্রিল -
জটিল হয়ে যাচ্ছে সবকিছু -
জটিল এর থেকে কমপ্লিকেটেড শব্দটা বোধহয় মানানসই ।

যাকগে ব্যক্তিগত জীবনের কাব্য - ইহা পড়িয়া কাহারও ইহকাল-পরকালের এমন কোন পরিবর্তন হইবে না - কাজেই - ফুলস্টপ ..

তবে লিখবো,

ব্লগে কিছু যান্ত্রিক পরিবর্তন আসলেও আসতে পারে -
সেই জন্যে আগেভাগেই ক্ষমা প্রার্থনা ।

-------
সাবটাইটেলে..
এই আমি যদি জেগে উঠি অন্য কোন সময়ে অথবা অন্য কোন পৃথিবীতে ,তবে কি পারতাম আমি অন্য একজন হয়ে উঠতে ?
এই ভাবকাব্যটুকুর জন্যে রাবাব এর কাছে কৃতজ্ঞতা ।
থ্যাংকু .. রাবাব !

-------
ছবিটা অন্য কারও তোলা, আমার নয় ।
কৃতজ্ঞতা তার কাছেও ।