শনিবার, আগস্ট ১৩, ২০০৫

চক্র

একটি ছোট্ট নৌকো পাল তুলে পাড়ি দিচ্ছে অনন্ত আকাশে ধীর, অতি ধীর তার গদিত নৌকোয় কয়েকজন মানুষ একটি শিশু, একটি বালক, এক কিশোর, একজন যুবক এবং জনৈক বৃদ্ধ নৌকোর গতি ধীর চারদিকে গাঢ় অন্ধকার মাঝে মাঝে ছুটে আসছে অনিকেত উল্কা মহাজাগতিক ধুলো মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে দূরাগত মহাবিস্ফোরণ বা সংঘর্ষ বা ঘূর্ণনের শব্দ নক্ষত্রমণ্ডলীয় ক্ষীণ আলোর আভায় তারা পরস্পরের মুখ দেখতে পাচ্ছে তারা চলেছে ধীরে কিন্তু অনায়াসে পেরিয়ে যাচ্ছে গ্রহ, নক্ষত্র, অতিকায় তারা বা কৃষ্ণগহ্বর

বুড়োর হাতে পেনসিল, হাঁটুর ওপর রাখা একটা খাতা বুড়ো মন দিয়ে একটা অঙ্ক কষছে যুবকটি জিজ্ঞেস করে, আর কত দূর ?
বুড়ো খরখরে গলায় বলে, আর বেশি দূর নয় বাবারা এসে গেছি তবে ঠিকানাটা বড্ড প্যাঁচালো, অনেকটা ধাঁধাঁর মতো এই অঙ্কটা মিলে গেলেই ঠিকানাটা বেরিয়ে আসবে
কিশোরটি বলে, আমার যে খিদে পেয়েছে বুড়ো
আর একটু চেপে থাকো বাবা, কাছেপিঠেই এসে গেছি অঙ্কটা মিললেই হয়ে গেল
পিছনের বাচ্চাটা বলে উঠল, তুমি যে বলেছিলে বাবার কাছে নিয়ে যাবে !
হ্যাঁগো দাদুভাই, বাবাও এখানেই আছেন এইসব ধাঁধাঁধন্ধ কেটে গেলেই বাপের কোল একটু রোখো বাবাসকল, অঙ্কটা মিললেই হয়
বালকটি বলে ওঠে, আর অঙ্ক না মিললে ?
না মিলে কি উপায় আছে শালার ? সহজে ছাড়ব ভেবেছ ? সেই কবে থেকে কষে আসছি, কষতে কষতে বুড়ো হয়ে গেলুম, না মিললে চলবে কেন ?

যুবকটি চড়া গলায় বলে, অনেকক্ষণ ধরে তুমি ধাপ্পা দিয়ে যাচ্ছ বুড়ো, তোমার সব ফক্বিকারি তোমার চালাকি আমি বুঝে গেছি নৌকো ঝাঁকিয়ে এবার তোমাকে ফেলে দেব
বুড়ো ঘ্যাঁস,ঘ্যাঁস করে মাথা চুলকায় ছেলেগুলোর দিকে চোরা চোখে চায়, তারপর বলে, অঙ্কটার মধ্যে কিছু ফক্কিকারি ভয় আছে বটে, কিন্তু মিলে যাওয়ারই কথা
বাচ্চাটা চেঁচিয়ে বলল, আমি বাড়ি যাব
যাবে বইকী বাবা, যাবে বইকীএখানেই কাছেপিঠেই তোমাদের বাড়িঘর শুধু অঙ্কটা মিলে গেলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে বাড়ির ঘাটের ভিড়ে যাবে নৌকো
এসব তোমার চালাকি বুড়ো

বুড়ো আর্তনাদ করে ওঠে, না না, মাইরি বলছি আমি ঘাটের গন্ধ পাচ্ছি
যুবকটি হিংস্র গলায় বলে, ছাই পাচ্ছ তোমার সব মিথ্যে কথা
বুড়ো ভারী জড়সড় হয়ে বলে, না গো বাবাসকল, এই শেষের পথটুকুই যা গোলমেলে আর দু-চার লাইনের মধ্যে অঙ্কটা মিলে যাবে মনে হয় মেরে এনেছি প্রায় আর অঙ্ক মিললেই কেল্লাফতে
অঙ্কফঙ্ক আমরা বুঝি না আমরা বাড়ি যেতে চাই
বুড়ো ভয়ে ভয়ে বলে, সে তো আমিও যেতে চাই বাবা সকল একটু চেপে বসে থাকো, আর দেরি নেই
কতকাল ধরে তুমি একই কথা বলে যাচ্ছ বুড়ো ! আর নয়, এবার তোমাকে নৌকো থেকেই ফেলে দেব
বুড়ো ফঁত করে নাকটা ঝেড়ে নিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলে, তাহলে যে বড্ড পাপ হবে বাবা আত্মহত্যা যে পাপ
আত্মহত্যা ?
না আমাকে মারলে যে তুমি তোমাকেই মারবে
তার মানে ?
ভাল করে ঠাহর করে দেখ দিখি বাবা, আমার মুখখানা চেনা লাগছে না ?
না তো !
ওই যে একটা বড় তারা আসছে কাছে, তার আলোয় ভাল করে দেখ চেনা লাগে ?
যুবকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তাই তো ! তুমিই তো বুড়ো বয়সের আমি

বুড়ো শতখান হয়ে হেসে বলে, তাই তো বলছি বাবা, এক নৌকায় এই আমরা কজনা কি আলাদা ? ওই আঁতুড় থেকে এই সেকেলে বয়স অবধি একটাই যে লোক আলাদা আলাদা মনে হয় বটে, আসলে একটাই লোক যে,আবার একটা লোক হয়েও আলাদা বটে
তার মানে কী ?
ওইটেই তো ধাঁধাঁ আর ওই ধাঁধাঁর জন্যইতো শালার অঙ্কটা মিলে গিয়েও মিলতে চায় না কেবলই ফ্যাকড়া বেরোয় একটু চুপ করে বসো তো বাবারা আর একবার মাথা ঠাণ্ডা করে অঙ্কটা শুরু থেকে কষে দেখি কোথায় যে শালা ভুল হচ্ছে
সবাই চুপ করে বসে রইল নৌকোটা দুলে দুলে চলতে লাগল কত যুগ কেটে যেতে লাগল কত আলোকবর্ষ পার হল তারা তবু পৌঁছল না শুধু কাগজের উপর পেন্সিলের শব্দ হয়ে যাচ্ছে খস্ খস্ খস্ খস্

<চক্র:: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় :: ৪১৬ পৃষ্ঠা :: আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম প্রকাশ: ফ্রেবুয়ারি ২০০৫>

অসাধারণ একটা বই; গল্পের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কহীন এই রুপক অংশটুকু বই এর শেষ দুটো পৃষ্ঠা থেকে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছিনা । (কপিরাইটের কথা চিন্তা না করে!)

আমরা সবাই একটা চক্রে পড়ে আছি, শুধু চেষ্টা চক্রটা কাটিয়ে বের হয়ে আসার; ব্যাপারটা বোধহয় আত্মঘাতী, নয় কি?


কোন মন্তব্য নেই: