একটি ছোট্ট নৌকো পাল তুলে পাড়ি দিচ্ছে অনন্ত আকাশে
। ধীর, অতি ধীর তার গদিত নৌকোয় কয়েকজন মানুষ
। একটি শিশু
, একটি বালক, এক কিশোর, একজন যুবক এবং জনৈক বৃদ্ধ
। নৌকোর গতি ধীর
। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার
। মাঝে মাঝে ছুটে আসছে অনিকেত উল্কা
। মহাজাগতিক ধুলো
। মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে দূরাগত মহাবিস্ফোরণ বা সংঘর্ষ বা ঘূর্ণনের শব্দ
। নক্ষত্রমণ্ডলীয় ক্ষীণ আলোর আভায় তারা পরস্পরের মুখ দেখতে পাচ্ছে
। তারা চলেছে ধীরে
। কিন্তু অনায়াসে পেরিয়ে যাচ্ছে গ্রহ, নক্ষত্র, অতিকায় তারা বা কৃষ্ণগহ্বর
। বুড়োর হাতে পেনসিল, হাঁটুর ওপর রাখা একটা খাতা
। বুড়ো মন দিয়ে একটা অঙ্ক কষছে
। যুবকটি জিজ্ঞেস করে, আর কত দূর
?
বুড়ো খরখরে গলায় বলে, আর বেশি দূর নয় বাবারা
। এসে গেছি
। তবে ঠিকানাটা বড্ড প্যাঁচালো, অনেকটা ধাঁধাঁর মতো
। এই অঙ্কটা মিলে গেলেই ঠিকানাটা বেরিয়ে আসবে
।কিশোরটি বলে, আমার যে খিদে পেয়েছে বুড়ো
। আর একটু চেপে থাকো বাবা, কাছেপিঠেই এসে গেছি
। অঙ্কটা মিললেই হয়ে গেল
।পিছনের বাচ্চাটা বলে উঠল, তুমি যে বলেছিলে বাবার কাছে নিয়ে যাবে
!
হ্যাঁগো দাদুভাই, বাবাও এখানেই আছেন
। এইসব ধাঁধাঁধন্ধ কেটে গেলেই বাপের কোল
। একটু রোখো বাবাসকল, অঙ্কটা মিললেই হয়
। বালকটি বলে ওঠে, আর অঙ্ক না মিললে
?
না মিলে কি উপায় আছে শালার
? সহজে ছাড়ব ভেবেছ
? সেই কবে থেকে কষে আসছি, কষতে কষতে বুড়ো হয়ে গেলুম, না মিললে চলবে কেন
? যুবকটি চড়া গলায় বলে, অনেকক্ষণ ধরে তুমি ধাপ্পা দিয়ে যাচ্ছ বুড়ো, তোমার সব ফক্বিকারি
। তোমার চালাকি আমি বুঝে গেছি
। নৌকো ঝাঁকিয়ে এবার তোমাকে ফেলে দেব
।বুড়ো ঘ্যাঁস,ঘ্যাঁস করে মাথা চুলকায়
। ছেলেগুলোর দিকে চোরা চোখে চায়, তারপর বলে, অঙ্কটার মধ্যে কিছু ফক্কিকারি ভয় আছে বটে, কিন্তু মিলে যাওয়ারই কথা
। বাচ্চাটা চেঁচিয়ে বলল, আমি বাড়ি যাব
।যাবে বইকী বাবা, যাবে বইকী
। এখানেই কাছেপিঠেই তোমাদের বাড়িঘর
। শুধু অঙ্কটা মিলে গেলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে
। বাড়ির ঘাটের ভিড়ে যাবে নৌকো
। এসব তোমার চালাকি বুড়ো
।
বুড়ো আর্তনাদ করে ওঠে, না না, মাইরি বলছি
। আমি ঘাটের গন্ধ পাচ্ছি
। যুবকটি হিংস্র গলায় বলে, ছাই পাচ্ছ
। তোমার সব মিথ্যে কথা
।বুড়ো ভারী জড়সড় হয়ে বলে, না গো বাবাসকল, এই শেষের পথটুকুই যা গোলমেলে
। আর দু-চার লাইনের মধ্যে অঙ্কটা মিলে যাবে মনে হয়
। মেরে এনেছি প্রায়
। আর অঙ্ক মিললেই কেল্লাফতে
।
অঙ্কফঙ্ক আমরা বুঝি না
। আমরা বাড়ি যেতে চাই
।বুড়ো ভয়ে ভয়ে বলে, সে তো আমিও যেতে চাই বাবা সকল
। একটু চেপে বসে থাকো, আর দেরি নেই
।কতকাল ধরে তুমি একই কথা বলে যাচ্ছ বুড়ো
! আর নয়, এবার তোমাকে নৌকো থেকেই ফেলে দেব
।
বুড়ো ফঁত করে নাকটা ঝেড়ে নিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলে, তাহলে যে বড্ড পাপ হবে বাবা
। আত্মহত্যা যে পাপ
।আত্মহত্যা
?না
। আমাকে মারলে যে তুমি তোমাকেই মারবে
।
তার মানে
?ভাল করে ঠাহর করে দেখ দিখি বাবা, আমার মুখখানা চেনা লাগছে না
?না তো
!
ওই যে একটা বড় তারা আসছে কাছে, তার আলোয় ভাল করে দেখ
। চেনা লাগে
?যুবকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তাই তো
! তুমিই তো বুড়ো বয়সের আমি
।
বুড়ো শতখান হয়ে হেসে বলে, তাই তো বলছি বাবা, এক নৌকায় এই আমরা কজনা কি আলাদা
? ওই আঁতুড় থেকে এই সেকেলে বয়স অবধি একটাই যে লোক
। আলাদা আলাদা মনে হয় বটে, আসলে একটাই লোক যে,আবার একটা লোক হয়েও আলাদা বটে
।তার মানে কী
?
ওইটেই তো ধাঁধাঁ
। আর ওই ধাঁধাঁর জন্যইতো শালার অঙ্কটা মিলে গিয়েও মিলতে চায় না
। কেবলই ফ্যাকড়া বেরোয়
। একটু চুপ করে বসো তো বাবারা
। আর একবার মাথা ঠাণ্ডা করে অঙ্কটা শুরু থেকে কষে দেখি
। কোথায় যে শালা ভুল হচ্ছে
।
সবাই চুপ করে বসে রইল
। নৌকোটা দুলে দুলে চলতে লাগল
। কত যুগ কেটে যেতে লাগল
। কত আলোকবর্ষ পার হল তারা
। তবু পৌঁছল না
। শুধু কাগজের উপর পেন্সিলের শব্দ হয়ে যাচ্ছে খস্ খস্ খস্ খস্
।
<চক্র:: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় :: ৪১৬ পৃষ্ঠা :: আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম প্রকাশ: ফ্রেবুয়ারি ২০০৫>
অসাধারণ একটা বই; গল্পের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কহীন এই রুপক অংশটুকু বই এর শেষ দুটো পৃষ্ঠা থেকে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছিনা । (কপিরাইটের কথা চিন্তা না করে!)
আমরা সবাই একটা চক্রে পড়ে আছি, শুধু চেষ্টা চক্রটা কাটিয়ে বের হয়ে আসার; ব্যাপারটা বোধহয় আত্মঘাতী, নয় কি?